রেডিও রুয়ান্ডা: ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায় এবং ভারতীয় মিডিয়া!

GK Dutta
0

রেডিও রুয়ান্ডা ছিল রুয়ান্ডার জাতীয় পাবলিক রেডিও ব্রডকাস্টার, যা ১৯৯৪ সালের গণহত্যার সময় বিশ্বের নজরে আসে। রেডিওটি সে সময়ে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয় এবং তুতসি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল, যার ফলস্বরূপ এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে।

কীভাবে ১০০ দিনের গণহত্যার সূচনা হয়েছিল?
১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে, রুয়ান্ডায় এক নির্মম গণহত্যা শুরু হয়, যা ১০০ দিন ধরে চলেছিল। এর মধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, এবং অধিকাংশেই তুতসি জাতিগোষ্ঠী ছিল। এর শুরু হয়েছিল রেডিও রুয়ান্ডা ও RTLM (রেডিও টেলিভিশন লিবার মিল কলিনস)-এর মাধ্যমে প্রচারিত ঘৃণামূলক বার্তা থেকে।
১৯৯৪ সালের এপ্রিলের শুরুতে, রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছায়। তুতসি এবং হুতুদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলছিল অস্থিরতা, যার ফলে একটি গভীর জাতিগত বিভাজন সৃষ্টি হয়। রেডিও রুয়ান্ডা এবং RTLM তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তুতসি জনগণকে "কীটপতঙ্গ" হিসেবে চিত্রিত করে, এবং তাদের নির্মূল করার আহ্বান জানায়। এই ঘৃণামূলক ভাষণ শুধু সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেয়নি, বরং মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এক পর্যায়ে, এমন একটি আহ্বান প্রচারিত হয়েছিল, যা জনগণকে তুতসি হত্যার জন্য উজ্জীবিত করে এবং সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় রেডিওটি যেমন ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করেছিল, তেমনি এটি তাদের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ব্যবহার করে বিশাল জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া এমনভাবে কাজ করেছিল যে, রেডিও স্টেশনগুলোর বক্তব্য গুলো শাসক শ্রেণির মতো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রথমে নির্বিকার ছিল, এবং প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য অনেক দেরি হয়ে যায়। রেডিও রুয়ান্ডার এই বিষাক্ত প্রচারণার ফলে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

ডিজিটাল যুগ যদি ১৯৯৪ সালে বিদ্যমান থাকত, তবে কি হতো?
যদি ১৯৯৪ সালে ডিজিটাল যুগ বিদ্যমান থাকত, তবে গণহত্যার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত। বর্তমানের মতো ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং মোবাইল মেসেজিংয়ের মাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত। সোশ্যাল মিডিয়া এখন মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে তথ্য পৌঁছাতে পারে, ফলে তুতসি জনগণের বিরুদ্ধে ঘৃণার উত্তেজনা আরও বাড়ত।
এছাড়া, এই ধরনের তথ্য দ্রুত আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছানোর কারণে হয়তো দ্রুত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ হত, কিন্তু সেই একই সময়ে, স্থানীয় পর্যায়ে আরও বড় সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারত, কারণ অত্যধিক প্রকাশিত সহিংসতার ছবি ও ভিডিও আরও আতঙ্ক সৃষ্টি করত।
তবে, ডিজিটাল মাধ্যমের একটি ইতিবাচক দিকও ছিল, এটি আন্তর্জাতিক সাহায্যকে দ্রুত সংগঠিত করতে এবং গণহত্যার বাস্তব চিত্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে সাহায্য করতে পারত। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে, হয়তো বিশ্ব সম্প্রদায় তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নিত।

গণহত্যার পৃথিবীজুড়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব!
রুয়ান্ডার গণহত্যা বিশ্বব্যাপী সভ্যতা ও মানবাধিকারের প্রতি একটি গভীর শিক্ষা দিয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে যে, গণমাধ্যমের শক্তি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উস্কে দিতে এবং জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। এটি বিশ্বের কাছে এক গুরুতর বার্তা দিয়েছে যে, এমন ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, যেমনটি রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দেরিতে হয়ে ছিল।
গণহত্যার পরবর্তী কয়েক বছরে, রুয়ান্ডা পুনর্নির্মাণের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তবে এর শোক এবং ক্ষত পৃথিবী জুড়ে মানবতার প্রতি একটি কালো দাগ রেখেছে। আন্তর্জাতিক ভাবে, রুয়ান্ডার গণহত্যা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়েছে, বিশেষত "দায়িত্ব রক্ষা" (R2P) উদ্যোগের মাধ্যমে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধ করা সম্ভব হয়।

ভারতীয় মিডিয়া কি রেডিও রুয়ান্ডার পথ অনুসরণ করছে?
ভারতীয় মিডিয়া সম্প্রতি কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষ করে কিছু টেলিভিশন চ্যানেল তাদের সম্প্রচারে ঘৃণামূলক ভাষণ এবং বিভাজনমূলক সংবাদ প্রচার করছে। এটি এক ধরনের 'রেডিও রুয়ান্ডা'র পুনরাবৃত্তি, যেখানে মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সহিংসতা ও বিদ্বেষ প্রচারিত হচ্ছে।
যদিও ভারতীয় মিডিয়া একটি বহুমুখী ক্ষেত্র, তথাপি কিছু সংবাদ চ্যানেল রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিভাজন তৈরি করছে এবং জনমনে বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এই ধরনের গণমাধ্যমের পরিবেশন পদ্ধতি, বিশেষ করে সহিংসতা বা ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করা, সমাজে বিপজ্জনক প্রভাব ফেলতে পারে, ঠিক যেমন রেডিও রুয়ান্ডা তুতসি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দিয়েছিল।
বিশ্বের প্রতিটি গণমাধ্যমকে অবশ্যই তাদের শক্তিশালী প্রভাব এবং দায়িত্ব বুঝতে হবে, যাতে তারা সমাজে সহিষ্ণুতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।

আমরা সকলেই মানবতার প্রতি দায়বদ্ধ। যে কোন মিডিয়া, সেটা রেডিও, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া বা যেকোন মাধ্যম, যেখানে ঘৃণাপ্রবণ বার্তা ছড়ায়, সেখানে আমাদের শব্দ, সত্য এবং সংহতির পক্ষে দাঁড়াতে হবে। সচেতন হওয়ার মাধ্যমে কোনও ধরনের বিভাজনমূলক প্রচারণা, হিংসা‑বর্ণবাদ বা ভীতি ছড়িয়ে দেওয়াকে আমরা জনগণ হিসেবে ঠেকিয়ে দিতে পারি, এবং সর্বোপরি ভালোবাসা, সংহতি ও মানবত্বের জয় নিশ্চিত করতে পারি।

তথ্যসুত্র:

◉ ORMD08961YD04188

full-width

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!