রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদী। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারণা সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। তিনি মনে করেন কোনো দেশের জাতীয় অগ্রগতি বিশ্বমানবজাতির অগ্রগতির একটি অংশ বিশেষ। তাঁর জাতীয়তা অর্থে ধারণা হল বিশ্বজনীন। তিনি সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারেননি। তিনি মনে করতেন স্বদেশ বা স্বদেশী আন্দোলন হল স্বাজাত্য বোধের অন্ধ অহমিকা। তিনি পশ্চিমী স্বাজাত্য বোধের অহমিকাকে ঘৃণা করতেন। তার জাতীয়তাবোধ হল সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় গন্ডি অতিক্রম করে বিশ্বমানবতায় সম্পর্কিত এক বিশ্বজনীন বোধ— যা সকল বেড়ার বাইরে, নক্ষত্রখচিত আকাশে সমুজ্জ্বল। তিনি নিজে একজন দেশপ্রেমিক হলেও উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী ছিলেন। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের জাতীয়তাবাদী ভাবনা একদিকে যেমন স্বদেশি চেতনার সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, অন্যদিকে তেমনই ইউরোপীয় জাতীয়তাবোধের অহমিকার মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদের পূজারি। তাই তার জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা ছিল। আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনার আলোয় আলোকিত। জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছিলেন, সেখানে কোনোরকম সংকীর্ণতার স্থান ছিল না।

ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সমালোচনা: রবীন্দ্রনাথ তাঁর'ন্যাশনালিজম' (Nationalism) গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। 1916-17 খ্রিস্টাব্দে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা নেন, সেগুলি নিয়েই তাঁর 'ন্যাশনালিজম' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ, বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তাঁর সমালোচনা করেন। পাশ্চাত্যের মাটিতে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম, তাকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ আর বিচ্ছেদের জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদ ধর্ম, মানবতাবাদ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এই কারণে পশ্চিমের দেশগুলিতে মারামারি-হানাহানি নিরন্তর ঘটে চলেছে। 'ন্যাশনালিজম' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ 'জাতীয়তাবাদ' সম্পর্কে তাঁর কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। নিজের দেশ, নিজের জাতি বড়ো আর অন্য সব দেশ, অন্য সব জাতি ছোটো ও নীচজাতীয়তাবাদের এই ধারণা যে বিভেদের বীজ বপন করে, তা ক্রমশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত তা দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে সময় বিশ্বে আধিপত্য কায়েমে সচেষ্ট হয়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি জাতীয়তাবাদকে আধিপত্যবাদ বা প্রভুত্ববাদ বলে অভিহিত করেছেন।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরোপ তথ্য পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। পরাধীন দেশগুলিকে শোষণ করে রিক্ত করে তোলাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতি এবং সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষে এক ভয়াবহ বিপদ। জীবনের অন্তিম লগ্নে 'সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধে গভীর দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে। মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি ... জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।"

জাতি ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর "শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধে একথা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জাতি (nation) গঠিত হয়েছে সত্যের জোরে কিন্তু জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সত্য নয়। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের দুর্বুদ্ধি, যেখানে দেশের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পায়। এ এমন এক রিপু যেখানে সকলের দিকে নয়, নিজের দিকেই টান বেশি থাকে।

জাতির চেয়ে মানুষ বড়ো: মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়ো। তাই তিনি জাতিপূজার কঠোর বিরোধিতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। জাতীয়তাবাদী ধারণা ব্যক্তিমানুষকে বলি দেয়। এখানে মানুষের সৃজনশীল সত্তার স্বাধীন বিকাশ ঘটে না। ব্যক্তিমানুষ নেশনের অধীনে যজ্ঞে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের জাতীয় গরিমার যে আবেগ মানুষের মনে বিভেদের সৃষ্টি করে, তা ক্রমশ মানুষকে দানবে পরিণত করে। মানুষের যাবতীয় শুভ চিন্তা, শুভ চেতনা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সংকট ডেকে আনে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ—পশ্চিমি সভ্যতার এই পথ কখনোই ভারতবর্ষের পথ হতে পারে না। ভারত কখনোই পাশ্চাত্যের ধারণায় 'নেশন' বা 'জাতি' ছিল না। ভারতের 'জাতি' সম্পর্কিত সমস্যা থাকলেও তা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না, ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তাই নানা যোদ্ধা জাতি ভারতে এসেছে কিন্তু তারা কেউ ভারতের সমাজব্যবস্থাকে স্পর্শ করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন। যে 'নেশন' বা 'ন্যাশনালিজম'-এর উগ্র উন্মাদনার দানবীয় রূপ কখনও ভারতের কাম্য হতে পারবে না। ভারতের কাম্য হল মহোত্তম মানবিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যে উদ্বুদ্ধ এক বিশ্বজনীন আদর্শের দেশ।

সমকালীন পৃথিবী যে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদের উদগ্র কামনায় মেতে উঠেছিল, সেসময় রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির ঐক্যচেতনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ধারণায় নিজের জাতির মধ্যে সকল জাতির এবং সকল জাতির মধ্যে নিজের জাতির সত্য রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে পরিভ্রমণের সময় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যে বক্তৃতা দেন। সেগুলিকে নিয়েই তাঁর 'Nationalism' নামক গ্রন্থটি রচিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেন। বিশেষত: ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেন। তিনি উগ্র জাতীয়বাদকে 'সভ্যতার সংকট' বলে মনে করেন। তাঁর মতে পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল অন্তর্দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি। যা এক জাতিকে অপর জাতির উপর প্রভুত্ব বা আধিপত্ত বিস্তার করতে প্রভাবিত করে। যার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে একজাতি অপর জাতির উপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্র হল আরাধ্য দেবতা স্বরূপ। যার বেদীমূলে জনগণ প্রণাম জানায়। আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করলেও রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের এরূপ ধারণাকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন মানব সভ্যতা বিকাশে জাতি সমূহের মধ্যে বিরোধ না, পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্ভাব, আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া প্রভৃতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনের ফলে মানবসভ্যতা বিপন্ন হয়ে উঠবে, তা মহামারীর রূপধারণ করবে। জাতীয়তাবাদের বিষান্ত পরিবেশ সহিষ্ণুতার পথ ত্যাগ করে আত্মঘাতী হয়ে উঠবে।

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে অন্ধ দেশভক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিহিত আছে তা মানুষকে নেশার মত আচ্ছন্ন করে মানুষের শুভ বুদ্ধিকে বিনষ্ট করে দেয়। জাতীয়তাবাদী ধারণার দ্বারা চালিত হলে মানুষের স্বাধীন বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় ও মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। তিনি মনে করেন জাতীয়তাবাদ এক দানব স্বরূপ। যা মানুষের জাতীয় পরিমার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবসভ্যতায় সংকট সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ তখন সাহাজ্যবাদে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন' কে দানবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নেশন-এর মধ্য দিয়ে জাতিসমূহের আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশ ঘটে। জাতীয়তাবাদের দ্বারা শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ অধিকতর দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ চালায় ও অবশেষে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে একটি জাতি অন্য জাতির কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অন্যায়ের প্রতিবাদী ছিলেন বলে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতিবাদ করেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি জাতি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অন্য জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে।

রবীন্দ্রনাথ স্বরাজ সম্পর্কে ধারণার একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেন। এ সম্পর্কে তাঁর ধারণা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মতানৈক্য সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পথ ও পাথেয় গ্রন্থে বলেন যে সমগ্র বিশ্ব যখন উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ তখন তিনি সমগ্র মানবজাতিকে ঐক্যবদ হওয়ার আহবান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতের অতীত ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি ভারতবর্ষে বিবিধের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠার সুমহান ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে নেন। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারণা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উগ্র জাতীয়তাবাদের গর্ভে ফ্যাসীবাদের উন্মেষ ঘটে যা মানবসভ্যতার বিপনস্বরূপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবতার স্থায়িত্বকে বিপন্ন করেছে বলে তিনি মনে করতেন। জাতীয়তাবানী ধারণার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হলে সভ্যতার সংকট দেখা দেয়। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে সংঘটিত দুটি বিশ্বযুদ্ধই এই বক্তব্যের সত্যতার স্বাক্ষর বহন করে।

ORM008212CW04372  Source: thesanjayverse.in

full-width