ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি উক্তি খুব বিখ্যাত৷ আমাদের দেশের অনেককেই দেখি সেটি উদ্ধৃতও করেন, ‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো’

আমরা চট করে লিখি বটে। কিন্তু প্রায় কেউই মন থেকে বিশ্বাস করি না! ভিন্নমত মানেই আমাদের কাছে অপরাধ! আমরা শুধু সহমত সহ্য করি, ভিন্নমত নয়৷ ভিন্নমতের জন্য জীবন দেয়া তো দূরের কথা, সুযোগ থাকলে ভিন্নমতের জীবন নিতে চাই আমরা! কয়েকদিন আগে আমি ‘আপনি ভলতেয়ারপন্থী না স্ট্যালিনপন্থী?' এই শিরোনামে একটি কলাম পড়েছিলাম। সেই শিরোনামের উৎস ছিল ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস, ‘সকল ভিন্নমতই কারও না কারও কাছে সহমত৷ এবং প্রত্যেকেই এক একটি সহমত ভাই৷ ভিন্নমত যতক্ষণ সহমতের লক্ষ্মণরেখার ভেতরে থাকে, ততক্ষণ ভলতেয়ারগিরি ঠিক আছে৷ গণ্ডি পার হলেই ভলতেয়াররা স্ট্যালিন হয়ে ওঠে।’ আমরা আসলে সবাই মুখে মুখে ভলতেয়ারপন্থি, আর চেতনায় স্ট্যালিনপন্থি৷

ভারতের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা ভিন্নমতের পরিস্থিতি নিয়ে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে৷ নানা আন্তর্জাতিক সূচকে বারবার গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থান নিচের দিকেই থাকে৷ কিন্তু সরকার বারবার দাবি করে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে৷ প্রমাণ হিসেবে তারা টিভির লাইসেন্স দেয়া, টিভি অন এয়ারে থাকা, অসংখ্য পত্রিকা-অনলাইন-এফএম রেডিওর উদাহরণ দেন৷ দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সরকারের সমালোচনা করেন৷ আমি বেশ কয়েকবছর ধরে লেখালেখি করি৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাকে কেউ কোনো চাপ দেয়নি৷ কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা গণমাধ্যমের সংখ্যা দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মাপতে চাইনা আমি৷ অনেকেরই ভিন্ন অভিজ্ঞতা আছে, তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে৷ একসময় সরকারের কঠোর সমালোচক অনেককে এখন আর টিভি টকশোতে দেখা যায় না৷ অনেকেই আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করতে চান না, এর দুটি কারণও আছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করার কারনে পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে৷আবার কেউ কেউ বলেন, প্রকাশ্যে সত্য বললে জীবিত থাকতে পারবো কিনা জানি না৷ মিথ্যা বলার চেয়ে না বলাই ভালো৷ এটাই আসল সমস্যা৷

আমরা অনেক কথা বলতে পারি, সব কথা বলতে পারি না৷ কতটুকু বলা যাবে, কতটুকু যাবে না; এই মাপকাঠি নির্ধারণই বড় সমস্যা৷ কে ঠিক করবে কাঠির এই মাপ৷ অথচ মাপকাঠি কিন্তু সংবিধানে ঠিক করে দেয়া আছে৷ সংবিধানে বলা আছে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা সংবিধান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেরা নিজেরাই একটা মাপকাঠি ঠিক করে নিয়েছি৷ এই স্বেচ্ছা নির্ধারিত মাপকাঠিই আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ অদৃশ্য এক ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়৷ এই ভয়কে জয় করতে না পারলে আমাদের কিছু কথা বলেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, পুরো কথা কখনোই বলতে পারবো না৷ CAA-NRC বিরোধী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন বা আরো আগের বিভিন্ন আন্দোলন সরকারের ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার উদাহরণ হতে পারতো৷ কিন্তু হয়নি সহনশীলতার অভাবে৷ CAA-NRC বিরোধী আন্দোলন তো সরকার পিটিয়ে দমন করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু বরাবরের মত এবারও প্রমাণিত হয়েছে, পিটিয়ে দমন করা যায় না, বরং তাতে আন্দোলন আরো চাঙ্গা হয়৷ আর কৃষক আন্দোলন দমন করতে সরকার মাঠে নামিয়েছিল জাতীয় সংবাদ মাধ্যম গুলিকে। প্রায় প্রতিদিন নিয়মকরে কৃষিক আন্দোলনকে নানান ভাবে বদনাম ও বানচাল করার চেষ্টা করা হয়। কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে উগ্রবাদী কার্যকলাপের সাথে তুলনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি শাসকলের নেতা-কর্মীরা। সরকারি দলের অনেককে বলতে শুনেছি, ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে৷ সমস্যাটা এখানেই৷ র্ধৈয্য কমে গেলে ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হতে পারেন৷ কারণ সরকারের ধৈর্য্যের সীমা মেনে তো আর আন্দোলন হবে না৷ আর সরকারের ধৈর্য্যের সীমা মানেই তো আন্দোলনের সীমা নয়৷

মানুষের মৌলিক অধিকার কোনটার কতটুকু সীমা সেটা কিন্তু সংবিধানেই লেখা আছে৷ নাগরিকদের বাক ও ভাব প্রকাশ এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরকার নির্ধারিত সীমা মেনে যেমন নয়, আবার যা ইচ্ছা তাই বলাও নয়৷ সমস্যা হলো সরকারের র্ধৈয্যের সীমা যেখানে শেষ, দমন সেখানেই শুরু৷ বিগত কয়েক দশক থেকেই আমাদের দেশের সরকার নিষ্ঠুর কায়দায় রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করে আসছে৷

আমাদের এই ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার কথাই দেখুন, বিজেপি বিরোধী দলে থাকতে আন্দোলন, সমাবেশ, মিছিল, হরতাল এমনকি রাজপথে সহিংসতাও করেছে৷ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মিছিল, সমাবেশ, হরতালসহ নিয়মতান্ত্রিক সব কর্মসূচি পালন করার অধিকার আছে৷ সংবিধানেও বলা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে৷’ যতক্ষণ কর্মসূচিটি শান্তিপূর্ণ থাকবে, ততক্ষণ পুলিশের কিছু করার কথা নয়৷ কিন্তু রাজ্যের বিরোধী দলগুলি মিছিল-সমাবেশ করতে নামলেই দুষ্কৃতিকারি বা হেলমেট বাহীনি আক্রমন চালায়। বাড়ী ঘরে আগুন, সন্ত্রাস যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। এখন অবশ্য রাজ্যের বিরোধী দলগুলি ঘনঘন রাস্তায়ই নামে না৷ পার্টি অফিস আর প্রেসক্লাবের চারদেয়ালের ভেতরেই তাদের সকল বিপ্লব সীমাবদ্ধ৷ সমাবেশ করার আগে আইনশৃঙ্খলা পুলিশকে জানানোটা জরুরি, কিন্তু সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি লাগবে, এটা আগে জানতাম না৷ এখন পুলিশ আসলে বিরোধী দলগুলিকে সমাবেশের অনুমতিই দেয় না৷ দিলেও শেষ মুহুর্তে গাদা গাদা শর্ত দিয়ে দেয়, যাতে ঠিকমত সমাবেশটি করতে না পারে৷ এভাবে বিরোধী দলগুলিকে কোনঠাসা করতে করতে রাজনীতিকে রাজপথ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্ত রাজপথ আমাদের ভালোই লাগে৷

কিন্তু মানুষের অধিকারের প্রশ্নে এই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ বিরোধী দলগুলিকে দমাতে শুধু যে সমাবেশ-মিছিলে বাধা দেয়া হয় তাই নয়; নেতাদের নামে সত্য-মিথ্যা মামলা দিয়ে দৌড়ের ওপর রাখা হয়৷ আর গুম-খুনের আতঙ্কও আছে৷ বিরোধী নেতারা সারাক্ষণ ভয়ে সিটিয়ে থাকেন৷ আসলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই বদলে গেছে৷ সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদলে ভয়ের সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে বেশি৷ সরকার বিরোধিতাকেই রাষ্ট্রবিরোধিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই রাষ্ট্রবিরোধিতার মামলা হয়৷ প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো সমালোচনাই যেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ অথচ এক সময় এই ভারতেই রাজনৈতিক বিরোধীতার চমৎকার সংস্কৃতি ছিল৷ শিল্পী আর.কে লক্ষ্মণ পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন রাজনৈতিক কার্টুন একে৷ একসময় তিনি দেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের নিয়ে অসংখ্য কার্টুন এঁকেছিলেন৷ সেই স্মৃতি যেন এখন সুদূর অতীত৷ ভিন্নমতের প্রতি আমাদের সত্যিকারের জিরো টলারেন্স৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর ভিন্নমতের শ্রদ্ধা বা পরমতসহিষ্ণুতার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে৷ কিন্তু মজাটা হলো আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই বটে, কিন্তু ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, সামান্য সহনশীলতাও নেই৷ সবার মত একরকম হবে না৷ ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য৷ কারও মতের সঙ্গে না মিললে আমি যুক্তি দিয়ে তার মত খণ্ডন করবো৷ পাল্টা মত দেবো৷ কিন্তু আমরা দেই গালি৷ তাও দুর্বল বলে গালি দেই৷ সবল হলে পিটাই বা দা দিয়ে কোপাই৷ এই আমরাই আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য গলা ফাটাই৷

আমার ইদানীং মনে হয়, ভারতের প্রধান বিরোধী দল ফেসবুক৷ যে কোনো ঘটনা ঘটুক, ফেসবুকে দ্রুত একটা জনমত গড়ে ওঠে৷ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার সেই জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে দ্রুত ব্যবস্থাও নিচ্ছে৷ ফেসবুক যদি মানদণ্ড হতো, তাহলে ভারতের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সূচক আরেকটু উর্ধ্বগামীই থাকতো৷ তবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অপরাধেই পিটিয়ে মারা হয়েছে অনেককেই। ফেসবুকে মানুষ অনেক স্বাধীনভাবে নিজের মতামত দেয় বটে, তবে এই ফেসবুক দেখলেই বোঝা যায়, ভিন্নমতের প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধা কতটা তীব্র৷ সারাক্ষণ গালাগাল, হুমকি, ভয় দেখানোই চলে সেখানে৷ এই ভয়ের সংস্কৃতিটাই আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে৷ সরকারি দলও ভয় দেখিয়েই জয় করতে চাইছে৷ কিন্তু আমার ধারণা এটা একটা বৃথা চেষ্টা৷ ভয় দেখিয়ে কখনো জয় করা যায় না৷ জয় করতে হয় ভালোবেসে।

ভারতের রাজনীতিটা বরাবরই কংগ্রেস বনাম অ্যান্টি কংগ্রেস ধারায় বিভক্ত৷ এমনকি ৮০এর দশকের নির্বাচনে কংগ্রেসের সুনামি জয়েও একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা্‌ক মানুষ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ছিল৷ স্বাধীনতার সময়ও কংগ্রেস বিরোধীরা স্বাধীনতা বিরোধিতা করেছে৷ স্বাধীনতার পর জনতা দল বর্তমান বিজেপি অ্যান্টি কংগ্রেস অংশের নেতৃত্ব দিয়েছে৷ বিজেপি যে কোনো মূল্যে কংগ্রেসকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে৷ কিন্তু কংগ্রেস ধ্বংস হলেই কি অ্যান্টি বিজেপি ভোটাররা হারিয়ে যাবেন নাকি তারা বিজেপিকে ভোট দেবেন? প্লাস-মাইনাস ৪৫ শতাংশ ভোটার বিজেপির বিপক্ষে৷ একটা সুষ্ঠু নির্বাচন বোঝা যাবে, সংখ্যাটা বেড়েছে না কমেছে৷ ভালোবাসা দিয়ে হয়তো এদের কাউকে কাউকে বিজেপি নিজেদের দিকে টানতে পারবে, কিন্তু ভয় দেখিয়ে, দমন করে কখনোই নয়৷ বরং দমন করতে গেলে সেই সংখ্যাটা আরো বাড়তে পারে৷ ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না, জোর করে যায় না দমন করা৷

CR007976CV02899
full-width