বাঙালি ইতিহাস বিমুখ জাতি, বাঙালির ইতিহাস নেই-বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ঐতিহাসিক তাঁদের একাধিক রচনায় এ জাতীয় আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্যটি এ ব্যাপারে অবশ্যই স্বাতন্ত্যের দাবীদার। ইতিহাস সম্পর্কিত এ জাতীয় আক্ষেপোক্তি এ রাজ্যের ক্ষেত্রে সর্বাংশে প্রযোজ্য নয়। ইংরেজের হাতেই এদেশে প্রথম ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত। কিন্তু তারও বহু আগে মধ্যযুগে অর্থাৎ সুদূর পঞ্চদশ শতাব্দীতে ত্রিপুরা রাজ্যের মাণিক্য উপাধিধারী রাজারা ইতিহাস চর্চার শুভ সূচনা করে গিয়েছিলেন। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা না হলেও বাংলা ভাষায় সমস্ত রাজকার্য পরিচালিত হতো। রাজাদেরই আগ্রহে এ রাজ্যের রাজসভায় বাংলা ভাষায় একসময় রাজ-ইতিহাস রচিত হয়েছে। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে একাধিক সভাকবি রচনা করেছিলেন শ্রীরাজমালা কাব্যের এক- একটি লহর। মধ্যযুগের সমগ্র বাংলা সাহিত্য যেখানে কোনো না কোনো ভাবে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছে, সেই সময় ত্রিপুরা রাজ্যে কাব্যের আধারে ইতিহাস রচনার এই প্রয়াস একটি অভিনব বিষয়। মধ্যযুগের রচনাশৈলী অনুসরণে রচিত এই কাব্য কোন দৈবী-মাহাত্ম্য প্রচারে রচিত নয়, বরং রাজা ও রাজবংশের কীর্তি-কাহিনি অর্থাৎ রক্ত-মাংসের বাস্তব মানুষের কথা বলার জন্যই এ কাব্য রচনার আয়োজন করেছিলেন ত্রিপুরার রাজাবৃন্দ।
মধ্যযুগে রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষাতে একাধিক কাব্য রচিত হলেও রাজপ্রশস্তিমূলক কাব্য বেশি লেখা হয়নি। অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্য এই তিন শাখাতে রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী শ্রীরাজমালা কাব্য। কেননা রাজবংশের ইতিহাস রচনার প্রয়োজনে ত্রিপুরার রাজসভায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা দেখা দিলেও কবি শুধুমাত্র ইতিহাসের সাল তারিখ ও যুদ্ধ বর্ণনার বিবরণমাত্র রচনা করেন নি। সুবৃহৎ এই গ্রন্থটিতে ত্রিপুরার রাজতন্ত্রের ধারাবাহিক ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে সমকালীন বৃহত্তর ত্রিপুরার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও বর্ণিত হয়েছে। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন- রাজমালা ক্রিপুরা রাজবংশের বৃত্তান্ত হইলেও ইহার সঙ্গে উক্ত অঞ্চলের তদানীন্তন সমাজ ও ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে...সেই সময়ের স্থানীয় রাজনীতি ও ইতিহাসের উপাদান হিসাবে এই ইতিহাসকাব্যের মূল্য স্বীকার করিতে হয়।
দীর্ঘ দশক থেকে এই ক্ষুদ্র পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরায় বাঙ্গালী ও বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাকবিতন্ডা চলে আসছে। অনেকেই যারা ত্রিপুরা রাজ্যের রাজন্য ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নন তাঁরা রাজ্যের বাঙ্গালী ও বাংলা ভাষা নিয়ে বিদ্ব্যেশমূলক মতামত দিয়ে থাকেন এবং যার মাধ্য দিয়ে জাতি-উপজাতি জনগনের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। এমন একটি সময়ে রাজমালা ইতিবৃত্তি সময়পযোগি। ত্রিপুরার গৌরবময় অতীত ইতিহাস স্কুলপাঠ্যরুপে প্রথম প্রনয়ন করেন স্বর্গীয় ভুপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়। তাঁহার বিরচিত এই রাজমালা তিনি নিজেই ১৩৫১ ত্রিপুরাব্দে প্রকাশ করেন।
ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের শাসনকালের (১৯২৩-১৯৪৭ খ্রিঃ) বিভিন্ন সময়ে কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় শ্রীরাজমালা কাব্যের লহরগুলি প্রকাশিত হয়। কাব্যটি মোট চারটি লহরে বিভক্ত। প্রথম লহর ধর্মমাণিক্যের (১৮৩১-১৪৬২ খ্রিঃ) আদেশ অনুসারে রচিত, তাতে রয়েছে দৈত্য থেকে মহামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ। এই লহরের রচয়িতা হলেন পণ্ডিত ভ্রাতৃদ্বয় শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর, আর বক্তা হলেন চতুর্দশ দেবতার চন্তাই (পুরোহিত) দুর্লভেন্দ্র। প্রতক্ষ্যদর্শী চন্তাই রাজপরিবারের দেব সেবার কাজ ছাড়াও রাজ বংশাবলী ও রাজত্বের ইতিহাস কণ্ঠস্থ রাখতেন। তাঁরই বক্তব্য অনুসারে রাজবংশের সুদীর্ঘ রাজকীয় কাহিনি পণ্ডিত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর এ কাব্যের প্রথম লহরে লিপিবদ্ধ করেছেন।





full-width