
"বাংলা ভাষাভাষী মানেই বাংলাদেশি" এই বিতর্ক সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রা যুক্ত করেছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মন্তব্য, দিল্লি পুলিশের চিঠি এবং বিজেপি আইটি সেল প্রধান অমিত মালব্যর এক্স (পূর্বতন টুইটার) পোস্ট, সবই এক সাংবিধানিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে: ভাষা দিয়ে নাগরিকত্ব নির্ধারণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধারণা কতটা ঐতিহাসিক সত্য, কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
বাংলা ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। এর উৎপত্তি হয় প্রায় এক হাজার বছর আগে প্রাচীন মাগধী প্রাকৃত ও পালি ভাষা থেকে। মধ্যযুগে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, কৃত্তিবাস, আর আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মনীষীরা বাংলা ভাষাকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানে বসবাসরত পূর্ব বাংলার মানুষ বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে জীবন দেন, ভাষার জন্য রক্তদান বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। জাতিসংঘ এই দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকায় কোটি কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে বাংলা একটি স্বীকৃত ভাষা। তাহলে সেই ভাষায় কথা বলা একজন মানুষ কীভাবে “বাংলাদেশি” হয়ে যেতে পারেন?
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মন্তব্য
অসমের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "যদি কেউ জনগণনায় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা লেখেন, তাহলে আমরা বুঝতে পারব রাজ্যে কত বিদেশি রয়েছে।" এমন মন্তব্য ঘিরে তীব্র বিতর্ক দেখা দেয়। তিনি আরও বলেন, “অসমীয়াই একমাত্র রাজ্যের সরকারি ভাষা, অন্য ভাষাকে ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার করা চলবে না।” তাঁর এই মন্তব্য স্পষ্টতই বিভাজনমূলক। ভাষার ভিত্তিতে বিদেশি চিহ্নিত করার এই চিন্তাধারা অসাংবিধানিক এবং বিভ্রান্তিকর।
দিল্লি পুলিশের চিঠি
দিল্লি পুলিশ সম্প্রতি এক অভ্যন্তরীণ নোটিশে “বাংলাদেশি ভাষা” হিসেবে বাংলা ভাষার উল্লেখ করে, যা আরও বিতর্ক সৃষ্টি করে। এটি শুধুই প্রশাসনিক গাফিলতি নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত ভাষাবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
অমিত মালব্যর মন্তব্য
অমিত মালব্য বলেন, "বাংলা নামে কোনও ভাষা নেই, এটি বিভিন্ন উপভাষার সমষ্টি যেমন সিলেটি, চট্টগ্রামি।" এই মন্তব্য স্পষ্টতই ইতিহাসবিরোধী এবং সাংস্কৃতিক অজ্ঞতার প্রতিফলন। বাংলা ভাষা বিশ্বসাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে স্বীকৃত, যার সাহিত্য, ব্যাকরণ ও ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত।
এই বিতর্ক আসলে গভীর এক জাতিগত রাজনীতির প্রতিফলন। অসমে বহু দশক ধরে 'বাঙালি বনাম অসমিয়া' সত্তার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। অন্যদিকে NRC, CAA ও জনগণনা ইস্যু ঘিরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। এখন ‘ভাষা’কে একটি জাতীয়তার পরিচায়ক হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রয়াস চলছে। এবং এই প্রচেষ্টা দেশের জন্য বিপজ্জনক।
ভারতের মতো একটি বহু ভাষার দেশে, ভাষা কখনোই নাগরিকত্ব নির্ধারণের উপায় হতে পারে না। বাংলা ভাষায় কথা বলার অর্থ বাংলাদেশি হওয়া নয় বরং তা এক গৌরবময় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করে। এই ধরনের বিভ্রান্তিকর, বৈষম্যমূলক ও ইতিহাসবিরোধী মন্তব্য একদিকে যেমন সামাজিক বিভাজন বাড়ায়, তেমনি দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর আঘাত হানে।
একটি ভাষাকে 'বিদেশি' বানিয়ে ফেলা মানেই শুধু ভাষাভাষীদের নয়, এক ঐতিহাসিক সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা। এখন প্রয়োজন, ইতিহাস ও সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার মর্যাদা ও মানুষের অধিকারের সুরক্ষা।
বাংলার ঐতিহ্য, জাতীয় সঙ্গীত, সব বাংলা ভাষায়, বাংলা সংস্কৃতিতে গড়া। বাংলা কোন বাংলাদেশি উপজাতি নয়। ব্যতিক্রমধর্মী সংস্কার ও চিন্তাধারাগুলো যারা চালু করছেন, তাদের উচিত সাংবিধানিক সমতা ও সংহতি বজায় রাখা, ভাষা, সাংস্কৃতিক সন্মান প্রদর্শন করা।
