দেবারতি মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ প্রতিভা, যিনি তাঁর চমৎকার লেখনী এবং গভীর গবেষণার মাধ্যমে পাঠকদের নতুন এক জগতে প্রবেশ করান। তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস "ঈশ্বরের অন্তিম শ্বাস" কেবল একটি বই নয়, বরং এটি বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকা এক মহান ব্যক্তিত্ব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের একটি বিস্মৃত এবং প্রায় অদেখা অধ্যায়ের হৃদয়স্পর্শী উন্মোচন। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে বিদ্যাসাগরকে আমরা মূলত সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও বিধবা বিবাহের প্রবর্তক হিসেবে জানি। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ সতেরোটি বছর, যা তিনি বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের এক অখ্যাত গ্রাম কার্মাটাঁড়ে কাটিয়েছিলেন, সেই সম্পর্কে তথ্যের অভাব ছিল। দেবারতি মুখোপাধ্যায় তাঁর গভীর গবেষণা এবং সংবেদনশীল লেখনীর মাধ্যমে সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন।
আমার মত যারা মনে করেন, বিদ্যাসাগর শুধু বিধবা-বিবাহ চালু করেছিলেন, শুধু বর্ণপরিচয় লিখেছিলেন এই বইটি তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যে বিদ্যাসাগর সত্যিকার অর্থেই দয়ার সাগর ছিলেন। উপন্যাসটি বিদ্যাসাগরের জীবনের শেষ অধ্যায় থেকে শুরু হয়, যখন তিনি পরিবার এবং সমাজের প্রতি হতাশ হয়ে কার্মাটাঁড়ের সহজ-সরল সাঁওতাল মানুষের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এই একাকী জীবন, যা অনেকাংশে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, সেটাকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উপন্যাসের মূল কাহিনি। বিদ্যাসাগর কেন সমাজের মূল স্রোত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, কাদের সঙ্গে তাঁর সুখ-দুঃখের আদান-প্রদান হয়েছিল, এবং তাঁর শেষ দিনগুলো কিভাবে কেটেছিল – এসব অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই উপন্যাসে। লেখকের বর্ণনাভঙ্গি এতটাই জীবন্ত যে, পড়তে পড়তে মনে হয়, আমরা যেন বিদ্যাসাগরের সেই নির্জন নিভৃত জীবনের অংশ হয়ে উঠেছি।
দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা এই বইটির মূল ভিত্তি। তিনি শুধু তথ্য সংগ্রহ করেননি, বরং সেই তথ্যের গভীরে প্রবেশ করে সেগুলোকে গল্পের বিভিন্ন স্তরে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যা পাঠকের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে। শোনা যায়, লেখক কার্মাটাঁড়ে গিয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের 'নন্দনকানন' বাড়িটি ঘুরে দেখেছেন, এমনকি তাঁর লাগানো আমগাছটিও দেখেছেন। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের ফলে বইটিতে এক অসাধারণ প্রামাণ্যতা এসেছে। পাঠক হিসেবে আমরা জানতে পারি, বিদ্যাসাগর সেখানে বসে কী কী কাজ করেছেন, কীভাবে স্থানীয় সাঁওতাল মানুষদের জন্য তিনি অকাতরে নিজের শেষ জীবন ব্যয় করেছেন, তাদের শিক্ষাদান করেছেন এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছেন। এই দিকগুলো আমাদের কাছে এক নতুন বিদ্যাসাগরকে তুলে ধরে।
এই উপন্যাসের চরিত্রায়ন সত্যিই অসাধারণ। বিদ্যাসাগরকে এখানে শুধু একজন মহামানব হিসেবে নয়, বরং একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে – যিনি দুঃখ ভোগ করেছেন, হতাশ হয়েছেন, সমাজের প্রতি অভিমান করেছেন, কিন্তু তবুও মানবতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো কমেনি। তাঁর ভেতরের দ্বন্দ্ব, বেদনা, এবং মানবপ্রেম যেন পাঠকের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কার্মাটাঁড়ের স্থানীয় চরিত্রগুলোও এত স্বাভাবিকভাবে এসেছে যে, তারা বিদ্যাসাগরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তাদের সরলতা, বিশ্বাস, এবং বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা – সবকিছুই অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
"ঈশ্বরের অন্তিম শ্বাস" কেবল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি জীবনীমূলক উপন্যাস নয়, এটি মানবতার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, নিঃস্বার্থ সেবা এবং জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার একটি চমৎকার উদাহরণ। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের মহানুভবতা কখনো পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করে না; বরং এটি নীরবে মানবজাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে। এই বইটি পড়ার পর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণা অনেকটাই বদলে যায় এবং তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়।
যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, যারা মহান ব্যক্তিত্বদের অজানা জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, এবং যারা এক মর্মস্পর্শী ও চিন্তামূলক উপন্যাস পড়তে চান, তাদের জন্য দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের "ঈশ্বরর অন্তিম শ্বাস" একটি অবশ্যপাঠ্য বই। এটি বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ, যা দীর্ঘদিন স্মরণে থাকবে।
◉ ORMD08866YD02045