প্রলোভনের ফাঁদে প্রান্তিক জীবন ক্ষয়ে যায়।

GK Dutta
0

এক সিংহ ব্যামোতে বড় কাবু হয়ে পড়েছে, গুহা ছেড়ে নড়বার ক্ষমতা নেই। সে তখন তার প্রিয় অনুচর খাঁকশেয়ালকে বললে, শোন, তুমি যদি আমায় বাঁচিয়ে রাখতে চাও তাহলে এক কাজ করতে হবে তোমায়। বনে যে বড় হরিণটা আছে নানা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে নিয়ে আসবে আমার একেবারে কাছে। বড় খিদে পেয়েছে আমার, তার মাংস, কলজে খেতে পেলে তবে আমার জানটা বাঁচে।

সিংহের কথায় বেরুল সেই বড় হরিণটার খোঁজে, একটু পরে তার দেখাও পেয়ে গেল। সে তখন হরিণকে বললে, শোন ভাই, জবর এক সুখবর এনেছি তোমার। তুমি তা জানই আমাদের এ বনের রাজা যে সিংহ, তার গুহার কাছাকাছি থাকি আমি। রাজার আমাদের ভীষণ অসুখ, একেবারে মরোমরো অবস্থা। বাঁচবার কোনই আশা নেই।

এখন তাঁর ভাবনা হয়েছে, তিনি চোখ বুজলে এ বনের রাজা হবে কে? কাকে তিনি তাঁর এ রাজত্বটা দিয়ে যাবেন? তিনি বলছেন - শুয়োরকে দেওয়া যায় না, ওর মাথায় গোবর পোরা, ভালুক কুড়ের বাদশা, চিতার তিরিক্ষে মেজাজ, বাঘটা ভবঘুরে । সুতরাং এদের কাউকে বনের রাজা করা যায় না। অনেক ভেবেচিন্তে বিচার করে শেষে তিনি তোমাকেই বনের রাজা করে যাবেন ঠিক করেছেন - এর কারণ হচ্ছে - তিনি বলছেন বেশ উঁচু, বড়সড়ো জমকালো চেহারা তোমার, বাঁচবেও অনেক দিন, তা ছাড়া তোমার মস্ত বড় শিং দেখলে সাপেরা সব ভয়ে পালাবে। মোট কথা তোমাকেই তিনি বনের রাজা করে যাবেন ঠিক করেছেন।

একটু থেমে শেয়াল বললে, শুনলে ত সব, এখন এই সুখবরের জন্যে আমায় কি দেবে তাই বলো ; একটু তাড়াতাড়ি বলো, কারণ এখনই ফিরতে হবে আমায়। সিংহ আমার পথ চেয়ে বসে আছেন, সব কাজেই যে আমার পরামর্শ নেওয়া দরকার বোধ করেন তিনি। হ্যাঁ, আর একটা কথাঃ এই বুড়ো শেয়ালের যুক্তি নেওয়া যদি তুমি ভাল মনে করো, তা হ’লে আমি বলছি, তুমি এখনই আমার সঙ্গে চলো, গিয়ে রাজা না মরা পর্যন্ত তুমি তাঁর কাছেই থাক।

শেয়ালের মুখে এই সব কথা শুনে আনন্দে আর গর্বে ফুলে উঠল হরিণের বুক, কোন কিছু সন্দেহ না করে সে তখনই শেয়ালের সঙ্গে হাজির হল সিংহের গুহায় একেবারে তার সামনে। কাছে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিংহ এক থাবা বসাল বটে, কিন্তু সে থাবটা লাগল গিয়ে হরিণের শুধু কানে। হরিণ অমনি ছুটে পালাল বনে।

এত চেষ্টা সব ব্যর্থ হ’ল দেখে শেয়াল নৈরাশ্যে একেবারে ভেঙে পড়ল, সিংহ হাতে পেয়েও হরিণটা খেতে পারল না - তাই দুঃখ, ক্ষোভ, রাগ আর খিদের জ্বালায় কেমন অদ্ভুত এক গর্জন করতে লাগল।

একটু পরে সিংহ খিদের জ্বালায় আর না থাকতে পেরে শেয়ালকে বললে, তুমি আর একবার যাও না হে, চেষ্টা করে দেখ ভুলিয়ে-ভালিয়ে হরিণটাকে আর একবার আমার কাছে আনতে পার কিনা৷ শেয়াল বললে, এ বড় কঠিন কাজের ভার দিচ্ছেন আমায়, মহারাজ, তবু বলছেন যখন তখন দেখি একবার চেষ্টা করে।

এই বলে লেজ নেড়ে শিকারী কুকুরের মত হরিণের খোঁজে চললে শেয়াল পথে কয়েকটি রাখলকে দেখতে পেয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলে, এ পথে তোমরা একটা হরিণকে যেতে দেখেছ তার কান দিয়ে রক্ত ঝরছে? হ্যাঁ দেখেছি, হরিণটা ঐ বনের দিকে গেছে। রাখালদের কথায় ঐ বনে যেতেই শেয়াল হরিণের দেখা পেলে। শেয়ালকে দেখেই রাগে হরিণের গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে উঠলঃ বজ্জাত, বেঈমান, আবার তুই আমায় ধরতে এসেছিস? সাবধান, আর এক পা তুই আমার দিকে এগুবি না, কাছে এলেই এই শিং দিয়ে গুতিয়ে তোকে শেষ করে দেব। রাজা করবার লোভ দেখিয়ে বজ্জাতি করবি ত আর কারো কাছে যা দূর হ তুই আমার সামনে থেকে শয়তান।

শেয়াল উত্তরে বললে, তুমি যে এমন কাপুরুষ সে কথা, ভাই আমার আগে জানা ছিল না, তা ছাড়া আমরা যারা তোমার হিতার্থী বন্ধু তাদের তুমি এমন সন্দেহের চক্ষে দেখ, তাও জানতাম না। জানলে, যাক সে কথা। শোন তোমায় হক কথা বলিঃ সিংহ তোমার কান ধরেছিল কেন জানো? কান ধরেছিল মরবার আগে তোমায় কিছু উপদেশ দিতে, রাজ্য চালনার গুরু দায়িত্ব সম্বন্ধে কিছু বলতে, তা তুমি এমনি ভীতু যে একটা রুগ্ন অথর্ব জীবের একটা নখের আঁচড় লাগতেই পালিয়ে এলে? তোমার রাগ হয়েছে দেখছি, কিন্তু তোমার আর কতটুকু রাগ, তোমার চেয়ে অনেক বেশী রাগ হয়েছে তাঁর তোমার উপর। রেগে তিনি এখন বলছেন, না, হরিণকে আর নয়, নেকড়েকেই রাজা করে দিয়ে যাচ্ছি আমি বনের।

একটু থেমে শেয়াল বললে, একবার বুঝে দেখ, ভাই, নেকড়ে বনের রাজা হ’লে আমাদের কি দশা হবে। তাই বলছি, বিন্দুমাত্র ভয় না করে তুমি আমার সঙ্গে এসো, মেষের মত নিরীহ হয়ে এস, কোন ভয় নেই তোমার। বনের গাছে যত পাতা আছে আর আশেপাশে যত ঝরণা আছে সেসবের নামে শপথ নিয়ে আমি বলছি। সিংহ তোমার কোন ক্ষতি করবেন না। আর আমিও চাই না তুমি ছাড়া আর কেউ আমাদের এ বনের রাজা হয়। শেয়ালের মুখে এই সব মুখরোচক কথা শুনবার পর বেচারা হরিণের মন আবার গলে গেল, সে রাজা হবার আশা নিয়ে শেয়ালের সঙ্গে আবার চললো সিংহের গুহায়!

সিংহ প্রস্তুত হয়েই ছিল, হরিণটা সামনে যেতেই সে এবার তাকে মেরে তার হাড় মাংস মজ্জা করে খেতে লাগল। হরিণের কলজেটা তার দেহ থেকে এক দিকে ছিটকে পড়তেই শেয়াল একফাঁকে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে নিজেই সেটা খেয়ে ফেলল, তার মনে হ’ল এটা তার ন্যায্য পাওনা তার বকশিস ।

আর সব খাওয়া হয়ে গেলে সিংহ যখন হরিণের কলজের খোঁজ করছিল তখন শেয়াল বললে, মহারাজ, বৃথা খুঁজে মরছেন আপনি, ওর কোন কলজে ছিলনা। যে জীব শুধু একবার নয়, দু-দুবার সিংহের থাবার কাছে আসে, তার কি কোন কলজে থাকতে পারে?

গৌরবের মোহ যখন লোকের বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তারা আর তখন নিজেদের বিপদের কথা ভাবতে পারে না। গৌরবের মোহে বুদ্ধিনাশ।
ORM008057CW03456

full-width

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!