এই সোস্যাল মিডিয়া যখন প্রথম এল তখন হাতে গুনা কিছু লোক ছিলেন যারা এর ব্যবহার করতেন এবং তাঁদের অধিকাংশই যে সোস্যাল মিডিয়ার প্রকৃত মর্যাদা বজায় রেখে চলতেন তাঁতে কারো দ্বিমত আছে বলে আমার মনে হয় না। আস্তে আস্তে আজকাল প্রায় সকলেই ঢুঁকে গেছেন এতে, জীবনের একটা অঙ্গই হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া, এতে আমার কোন সন্দেহই নেই যে আজ থেকে পাচ-ছয় বছরের মধ্যে এটা বলা হবে যে ফেসবুক ছাড়াও মানুষ থাকবে কেন? আধার-পেন কার্ডের মতই ফেসবুক একাউন্ট থাকা বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়াবে। আর যাদের ফেসবুক থাকবেনা তাঁদের দিকে মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, একি! এ কি ধরনের উদ্ভট ব্যাপার! আপনার ফেসবুক একাউন্ট নেই, আস্তে আস্তে সেদিকেই যাচ্ছে জিনিষটা।

কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, আমি অনেক ভেবে চিন্তে দেখেছি যে, আপাতত বলতে পারেন আমার বুদ্ধিতে যা কুলয় আর কি, সোশ্যাল মিডিয়ার দু’ট প্রবনতা হচ্ছে মুল প্রবনতা। যার একটি হচ্ছে অবান্তরতা যার কোন অর্থ নেই সেরকম লেখা লিখে বা হাবিযাবি লিখে, যেমন আজকে ডাল খেলাম বা আজ আমার বমি-বমি ভাব করছে, এরকম একটা কিছু লিখে ফটো সহ বা ফটো ছাড়া পোষ্ট করা। এখানেই শেষ নয়, সেইসব হাবিযাবি পোষ্টে কমেন্টসও হচ্ছে আবার অনর্গল শেয়ার ও হচ্ছে। আর পোষ্টটি যদি স্ত্রী জাতি দ্বারা হয় তবেত সেরেছে, ব্যপারটা স্বতস্ফুর্তি দিয়ে করা হয়ে থাকে। যাইহোক একটা কিছু এমন পোষ্ট করা যার আক্ষরিক কোন গ্রহন যোগ্য অর্থই নেই। এ ধরেন অবান্তরতার মানেটা যে কী সেটা বুঝে উঠা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে যদিও সেটা অনেক কম ছিল কিন্তু যতদিন যাচ্ছে তত বেশী এইসব অবান্তর জিনিষ পোষ্ট করা বা শেয়ার করার প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁতে করে কার কি উদ্ধার হচ্ছে জানিনা তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তি ছড়ানো ছাড়া আপাতত আর কিছু হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।

আর দ্বিতীয় হচ্ছে ফেইসবুকে বা যেকোন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ইতরমোর উৎসব চলছে। এককালে ইতরতার ব্যাখ্যাটা কিছুটা এই রকম ছিল যে, যারা ইতর তাঁরা পার্কে বা রকে বসে আড্ডা দিত আর মেয়ে-ছেলেদের দেখে টোন কাটতো বা অন্যান্য অসভ্যতা করত বা ঢীল ছুড়ে মারত এইসব আর কি। সময়ের সাথে বা বলতে গেলে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাবহারের স্বার্থে, আজকাল ইতরামোর ধরনটাও পাল্টে গেছে। আজকাল আর তাঁরা আগের মত অসভ্যতা করেন না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তাঁরা যে মজাটা পেয়ে গেছে সেটা হল, যেকোন লোক কে ঘিরে ধরার আনন্দ। অর্থাৎ একটা লোক তাকে অনেক গুলো লোক মিলে অশ্রাব্য ভাষায় গালা-গাল দিচ্ছে। জিনিষটা কিছুটা গন ধোলাইয়ের মত। আর এই ধরনের ভার্চুয়াল গন ধোলাইয়ের আনন্দ আজকাল সব বিষয়েই উৎকর্ষতার সাথে দেখা যায়।

এবার সে যদি এমনি একটা লোক হয়, রাম, রহিম, যদু অথবা মধু তাহলে সে অল্পেতে বেঁচে গেছে, উনার ক্ষেত্রে অপমানের মাত্রাটা কম হতে পারে বেশী নয়। কিন্তু এবার যদি একটু খানি বিখ্যাত, বিখ্যাত’তো অনেক রকমের হয়, কেউ বিরাট বিখ্যাত, কেউ সাড়ে, কেউ পনে, কেউ আধা এরকম বিখ্যাত। এবার আমি সকাল বেলা উঠে, এখন বহুলোকের চাকরি, ভালোবাসার চাকরি এটা, আজকের টার্গেট টা ঠিক করে নেওয়া, আজকে কাকে কাকে যুক্তি ছাড়াই অপমান করতে হবে অর্থাৎ চার অক্ষর বা পাঁচ অক্ষরের অপমান করব। সেটা যে কেউ হতে পারেন। এবার তাকে সমালোচনা বা অপমান করতে হবে, এখন এটা বলার দরকারই নেই যে কি কারনে বা কি যুক্তিতে সমালোচনা বা অপমান করা হচ্ছে। শুধু বলা হয় “উনি আমার সাথে একমত নন, কারন তিনি একটি “চার অক্ষর” বা উনি এমনটা বলতে বা করতে পারেন না কারন তিনি একটি “পাঁচ অক্ষর”। এই হচ্ছে সমালোচনা এবং অপমানের স্থর। এখন শুধু দু’অক্ষর, তিন অক্ষর, চার অথবা পাঁচ অক্ষরের সমালোচনা ও অপমান করা হয়। এবং এই ধরনের সমালোচনা করে কিছু লোক আবার বিখ্যাতও হয়ে যাচ্ছেন, আজকাল তাঁরাও আইকন। কিছুদিন পর হয়তো তাঁদের বিরুদ্ধেও সমালোচনা শুরু হবে যে তিনি সমালোচনা করতে পারেন না কারন তিনি একটি “তিন অক্ষর”।

এবার বিষয়টা হচ্ছে দিনদিন অবান্তরতাকে চাপিয়ে এই ইতরমোর উৎসবটা ভয়ংকর ভাবে চলেছে। কারন আগে পাড়ার আড্ডায় বসে বা বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বা বাড়িতে বসে দু’চার জনের মধ্যে এই সমালোচনাটা হত। কারন আজকের দিনের মত কোন যুক্তি ছাড়াই সমালোচনা করা কোথাও সম্ভব হত না। কারো সমালোচনা করতে হলে সাথে উপযুক্ত যুক্তি বা কারন থাকাটা বাঞ্ছনীয় ছিল, কারন যদি আমি মনে করি “অমুক বাবু” যা বলেছেন বা করেছেন সেটা ঠিক নয়, তাহলে আমাকে যুক্তি দিতে হবে, সে যুক্তি যাইহোক, কত গুলো গালাগালকে যুক্তি হিসাবে খাঁড়া করে সমালোচনা করতে পারতাম না, কারন কোন ভাবেই গালাগালকে যুক্তি হিসাবে ধরা হত না।

এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা এসে গেছে, যে মুহূর্তে কেউ কোন বিষয় নিয়ে বা কোন ঘটনা নিয়ে উনার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করছেন, এই যে লাইসেন্সটা সোশ্যাল মিডিয়া দিচ্ছে যে সবাই রাজা, মানে “মিলবকি সত্যে নয়, পড়ে যাচ্ছি গর্তে”, যেটা হচ্ছে কিছু লোক করছে কি তাহলে আমি গালাগাল দেব, এবং সঙ্গে সঙ্গে জুটে যাচ্ছে তাঁর সমর্থনে অনেক লোক যারা বলছে কি ঠিক বলেছিস ও কিচ্ছু জানেনা, উনি এই, উনি সেই বলে একটা বিরাট গালাগালির বিপ্লব চলেছে। আগে সমাজের মেইনষ্ট্রিমে গালাগালি জিনিষটা ছিলনা বললেই চলে, অর্থাৎ আজকের দিনের মত কেউ কাউকে এভাবে প্রকাশ্যে গালাগাল দিতে পারতোনা বা দিত না। সামাজিক মর্যাদা বলে একটা কিছু ছিল এবং সবাই সেটা মেনে চলার চেষ্টা করত।

তারপর রিলায়েন্স জিও এর নেট সিরিজটা এলো, ইন্টারনেট ব্যবহারের যে কত উপকারিতা আছে এবং এর মাধ্যমে যে খুব অল্প সময়ে অনেক কিছু আয়ত্ত করে নেওয়া যেতে পারে তাঁতে কারো কোন আগ্রহই নেই, ঐ কম খরচে ইন্টারনেট পাওয়ার পর লোকে জেনে গেল যে কিস্তি করলেই বিপ্লবী হওয়া যায়, খিস্তী করলেই প্রগতিশীল হওয়া যায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ইনফেক্ট এখন বাংলা সিরিয়ালেও প্রচুর চলছে আপনি বাংলা সিরিয়াল বা নাটক দেখতে গেলে দেখবেন স্বাভাবিক কথা কেউ বলেনা প্রচুর গালাগাল দিয়ে কথা বলে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় যেটা হচ্ছে, আমি যেহেতু গালাগাল দিচ্ছি তাহলে আমি প্রগতিশীল, আমি যেহেতু ক্ষমতাবান লোকদের পক্ষে কথা বলছি সেহেতু আমি ক্ষমতাবান, তারমানে আমার মত বিপ্লবী বা দেশপ্রেমী আর কেউ নেই, আজকাল ভালো-কিছুতে লাইক আর কত হয়, গালাগালিতে অনেক দ্রুতগতিতে অনেক লাইক শেয়ার হয়, ফলে সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ ফেইসবুক, ওয়াটসএপ এরকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মুল কাজ এখন রেগে উঠা, এরকমও হয়, ধরুন বিকেল না হয় রাত মানে সারেদিনে একটা কিছু নিয়ে রেগে উঠতেই হবে, যেমন ধরুন রাত ১০টা বেজে গেল অন্যরা রেগে উঠেছে কিন্তু তাঁর কোন রাগই হয় নি, এবার তাঁর প্রচণ্ড একটা টেনশন শুরু হয়ে গেছে, অন্তত একটা কারণেও ত রাগ উঠতেই পারে, আমাদের ত্রিপুরা কিংবা ভারতবর্ষে প্রতিদিন কিছুনা কিছু ঘটে যাতে রেগে উঠা যায়, এবার একদিন হয়ত সেরকম কিছু ঘটেনি ত এবার কি করা যায়, শুরু হয় অমুক এটা বলবে, লিখবে বা করবে কেন, তমুক পাকিস্তানি, সে ওখানে যাবে কেন এরকম কিছু একটা বলে রেগে উঠতে হবে এবং রেগে তীব্র গালাগাল দাও এবং গালাগালের চেয়ে বেশী টি,আর,পি এখন আর কোন কিছুতে নেই। সমাজতাত্ত্বিকরা হয়ত বলবেন যে এত রকমের প্রচণ্ড হতাশা তিক্ততা বা বিভিন্ন কারণে জন্মাচ্ছে হয়ত কেউ বলতে পারেন পুঁজিবাদের প্রসারের জন্যই যারা শপিং মহলে গিয়ে ব্র্যান্ড-ডেড কিছু কিনতে পারছেন না, এতটাই হতাশ হয়ে যাচ্ছেন যে, যেকোনো কারণেই রেগে গিয়ে পক্ষে বা বিপক্ষে প্রচণ্ড গালাগাল দিচ্ছেন, অনেক রকম কারণ দর্শানো যেতে পারে, কিন্তু কোন কারনেইত অভদ্রতাকে অসভ্যতাকে আমি সমর্থন করতে পারিনা।

সোশ্যাল মিডিয়া সবসময় একটা তাৎক্ষনিকতার দাবী করে যে, এই আমাকে ব্যাবহার কর, চট করে একটা কিছু লিখে দাও বা ছবি পোষ্ট করে দাও, এইটার সব থেকে বড় ঝামেলা হচ্ছে এই যে না বুঝে না জেনে বা না ভেবে চিন্তেই চট করে একটা প্রতিক্রিয়া দিয়ে দেওয়া, এবং সেই প্রতিক্রিয়া যদি তৎক্ষণাৎ কিছু লাইক পায় তাহলে প্রতিক্রিয়াটা ভেলিডেইটেড হয়ে যায়, যেমন ধরুন আমি একটা বাজে কথা লিখলাম, তাঁতে যদি তৎক্ষণাৎ কিছু লাইক, শেয়ার বা কমেন্টস পাওয়া যায় তাহলে আমার মনে হতে থাকে যে নিশ্চয়ই লেখাটা ততটা বাজে নয় এমনকি আমি নিজে যতটা বাজে ভেবে ছিলাম তাও নয় কারণ তাহলে এত-গুল লোক আমাকে সমর্থন করছে কেন? এই যে সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে একটা ইতরতা আছে বা ইতরতাকে উস্কে দেওয়া আছে, এরই একধাপ এগিয়ে হচ্ছে আগ্রাসনকে উস্কে দেওয়া, যখন দেখছি আমার এই আগ্রাসন কোন রকমের সেন্সরশিপ ফেইস করছে না, আমি যে কোন লোককে যা খুশি বলে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারি।

প্রশ্ন হচ্ছে এই যে সাম্য? এটাইত হচ্ছে আজকের দিনের সব থেকে বড় সাম্য যে আমি যে কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু না জেনেই বাপ তুলে গালাগাল দিতে পারি যেকোনো সময়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সাম্যই কি আদও কাম্য? সকলের হাতেই সমান ক্ষমতা কথাটার মানে এই নয়কি যে অযোগ্য বা ইতরদের হাতে অধিক ক্ষমতা? আমার মনে হয় সেই দিকটা ভেবে দেখার সময় এসে গেছে।

“অন্যমনস্ক মানুষ যখন গর্তের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে তখন হটাৎ তাকে টেনে ধরলে সে হটাৎ মারতে আসে। যেই সময় পেলেই, দেখতে পায় সামনে গর্ত আছে, তখন রাগ কেটে যায়।“এখনও গর্ত যাদের চোখে পড়ছেনা তাঁদের টেনে ধরে সাবধান করার দরকারই নেই।

full-width