পণ দেওয়া এবং নেওয়া নিয়ে এযাবৎ কালের মধ্যে অনেক লেখা লেখি হয়ে গেছে, বিজ্ঞজনেরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং যথা সম্ভব আমাদের সভ্য সমাজের একটি অসভ্য রীতি নিয়ে আলোকপাত ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেছেন সে বিষয়ে কারো মনে কোন দ্বিমত আছে বলে আমার মনে হয়না। তাই সে বিষয়ে কিছু লেখার দুঃসাহস এবং অভিষ্যন্দী দুটোই আমার নেই।
আমি দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশী সময় থেকে গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করছি এবং সেই সাম্যক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এক অন্য দৃষ্টি কোনে আমি পণ দেওয়া নেওয়া নিয়ে আমার অভিমত ব্যক্ত করতে চেষ্টা করছি। হয়ত আমার লেখা অধিকাংশের কাছে অপ্রিয় এবং দৃষ্টি কঠোর লাগতে পারে তাঁতে আমি আশা করতেই পারি আপনারা নিজগুণে আমাকে ক্ষমা করবেন আর যদি নাও করেন তাঁতে আমার বিশেষ কিছু যায় আসেনা কারণ বাস্তব সত্য চিরকালই অপ্রিয় হয়ে থাকে।

“আজকাল আমরা পণ দেইও না নেইও না”, আমার কথা শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই, অবাক হবার কথাই, কারণ যে দেশে দৈনিক ২১জন মহিলা পণপ্রথার শিকার হচ্ছেন সেখানে দাঁড়িয়ে আমার কথা গুলি নিছক বাতুলতা বলেই মনে হতে পারে, তাঁতে কোন সন্দেহ নেই। আবার কোন কোন নারীবাদীরা এও বলতে পারেন যে, আমি পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের ধারাবাহক তাই এমনটা বলছি, সে যে যা বলুন ভাই, আমার কথা, আমার বলা চাই।

অন্তত পক্ষে আমি যোর গলায় এটা বলতেই পারি যে, আমি যা বলতে চাইছি তা একদম ফেলে দেওয়ার কথাত নয়ই বরং ভাববার বিষয় সুতরাং এখন থেকে ভাবা প্র্যাকটিস করুন। আজকাল পাত্রীপক্ষও যেমন পণ দেন না তেমনি পাত্রপক্ষও পণ নেন না, কারণ আজকাল আমরা শিক্ষিত হয়েছি, সে বটেই, আক্ষরিক অর্থে যথার্থ মানুষ হবার মত বা মনুষ্যত্ব বোধ না থাকলেও দু-চারটে ডিগ্রি তো হাতে আছেই আর কিছু থাক বা না থাক। আজকাল আমরা “উপহার” নেই, সে আমার কথা নয় আমাদের সমাজের সুশিক্ষিত বিজ্ঞজনদের কথা। পাত্রীপক্ষ তাদের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে দামী-দামী আসবাবপত্রের সাথে সাথে আরও অন্যান্য বিলাস বহুল আসবাবপত্র দিয়ে থাকেন, কারণ তাঁরা তাদের মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসেন আর সেই ভালোবাসার প্রতিকৃতি হিসেবে পাত্রপক্ষের কাছে কন্যাদানের সাথে সাথে সেইসব জিনিষপত্রও ভালোবাসার উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা ব্যক্ত করার পন্থাও পাল্টায়, এখন ফেসবুক-টুইটারের যোগ আর এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে যদি পণ নেই তাহলে ফেসবুক-টুইটারের স্ট্যাটাসটা ঠিক মানান সই হবে না তাই আমরা আজকাল “পণ” নয় “উপহার” দেই এবং নেই।

কোন এক সময় ছিল যখন পণ চাওয়া হত, আজকাল সেই পাঠ চুকে গেছে কারণ আজকাল আর পণ চাইতে হয়না, পাত্রীপক্ষ স্ব-ইচ্ছায় পাত্রপক্ষকে “পণ” ওহ: মাফ করবেন “পণ” নয় “উপহার” দিয়ে থাকেন আর পাত্রপক্ষ ভিক্ষুকের মত “উপহার” নামক পণ বাড়ি নিয়ে যান আর বীরত্বের প্রতীক হিসেবে নিজের ঘরে সাজিয়ে রাখেন। এখানে আমার কবিগুরুর দু’টি লাইন মনে পড়ে গেল…

কিছু কিছু অতি-শিক্ষিতরা এর স্বপক্ষে যুক্তিও দেখান, যেমন ধরুন মেয়ের পক্ষের যুক্তি হল আমরা আমাদের মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি এবং তার নিত্যদিন ব্যাবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষ উপহার হিসেবে আশীর্বাদ স্বরূপ দিয়ে থাকি, ছেলের পক্ষ-তো কোন দাবী করেনি তাহলে একে আপনি পণ বা যৌতুক বলছেন কেন? আমাদের মেয়ের কি আমাদের উপর কোন অধিকার নেই, আমরা কি আমাদের মেয়েকে বা মেয়ের জামাইকে উপহার দিতে পারিনা? সব মা বাবারাই নিজ নিজ সাধ্য এবং সামর্থ মত যা যা পারেন তাদের মেয়েকে দিয়ে থাকেন, তাঁতে দোষের কি আছে? আরে হ্যাঁ সে কথা ত আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, অধিকার বলে কথা, আচ্ছা দাদা-দিদিরা আপনার পিতৃতর্পণের অধিকারটা কি আপনার মেয়েকে বা বোনকে দিয়েছিলেন বা দেবেন? আপনার পরিবারের ছেলেকে যতটা স্বাধীনতা এবং সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন বা দিচ্ছেন ঠিক ততটা স্বাধীনতা এবং সুযোগ-সুবিধা কি আপনার মেয়েকে বা বোনকে দিয়েছিলেন বা দেবেন? উওরটা আমাদের সকলেরই জানা তাইনা!

আর রইল সাধ্য ও সামর্থের কথা, আপনাদের যদি মেয়ের আগামী দিনের চিন্তা মাথায় থাকে এবং মনে সদিচ্ছা থাকে তাহলে মেয়ের বিয়েতে লোক দেখানো আড়ম্বর না করে যতটা পারেন স্বল্পব্যায়ে বিবাহ দিতে চেষ্টা করুন আর আপনার মেয়ে বিয়ের বাজেটের অবশিষ্ট টাকাটা মেয়ের নামে ফিক্সড করে দিন তাঁতে মেয়ের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হয়ে যাবে, যদি ভবিষ্যতে মেয়ের কোন বিপদ আসে তাহলে সেই সঞ্চয় তার আশ্রয় হবে। কিন্তু না এটা কোন মা বাবাই করতে চাইবেন না, কারণ এতে লৌহিত্য থাকবে না।

আর পাত্রপক্ষের যুক্তি হল, বিয়েতে আমাদের কোন দাবী নেই আপনারা আপনাদের সাধ্যমত মেয়েকে সাজিয়ে দেবেন আর যা পারেন দেবেন, সুতরাং এটাকে পণ বা যৌতুক বলা যাবেনা কোন ভাবেই, সহজ যুক্তি একটাই আমরা মেয়ের পক্ষকে কোন কিছু দিতে যোর জবরদস্তি করছিনা অতএব এটাকে পণ বা যৌতুক বলা যাবে না। মোদ্দা কথা হল, “তরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই”। বাবা হবুচন্দ্র সামান্যতম আত্মসম্মান বোধ যদি থাকে তাহলে, সোজা-সুজি পাত্রীপক্ষকে বলতে পারণা যে আমি পাত্রী ছাড়া এই বাড়ি থেকে অন্যকোন বস্তু নেবনা সে আপনারা উপহার হিসেবেই দিন আর আশীর্বাদ হিসেবেই দিন। তাহলেই ত লেটা চুকে যায়, আর পাত্রপক্ষের সৎমানসিকতা প্রকাশ পায়। কিন্তু কে কার কথা শুনেন।
এখন একটা ছোট্ট গল্প বলি, রামের সাথে আমার বন্ধুত্ব হল, আমি রামের প্রতি আমার ভালোবাসা জাহির করতে গিয়ে রামকে আমি অনেক কিছু উপহার দিলাম। কিছুদিন পর মনে হল রাম ভালো ছেলে নয়, আমাদের মধ্যের বিবাদ দূরত্বে পরিণত হল, আমাদের বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়াল এবং আমাদের দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ হল। এখন সেই আমি যে রামের প্রতি আমার অঘাদ ভালবাসা জাহির করতে গিয়ে রামকে কিছু মূল্যবান দামী জিনিষ উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম, সেই সকল উপহার কে আমি রামকে আমার দেওয়া ধার বলে আদালত মারফত উপহার দেওয়া জিনিষ গুলি ধার দেওয়া জিনিষ বলে ফেরত চাইলাম, তখন ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? ঠিক তেমনটাই হয়, বিয়েতে দেওয়া উপহারের ক্ষেত্রে। কোন কারণে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গার্হস্থ্য হিংসার জেরে দুজনের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয় তাহলে এক সময় সেই ভালোবাসার উপহারই পণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আশীর্বাদ আর ভালোবাসার উপহার দুটি কথাই বদলে গিয়ে পণ আর যৌতুকে পরিণত হয়। আমি কোন ভাবেই এটা বলতে চাইছি না যে গার্হস্থ্য হিংসা পণ প্রথা দু’টিই এক জিনিষ। দু’টি এক না হলেও একি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবেনা যে, সব গার্হস্থ্য হিংসা পনের কারণে না ও হতে পারে কিন্তু, সব ধরনের পণ’ই গার্হস্থ্য হিংসার কারণ হয়ে থাকে।

বরাবরই আমরা রীতি, নিতি, শাস্ত্র এবং সংস্কৃতি’কে নিজেদের সুবিধা-মত ব্যবহার করে থাকি, যখন যেখানে যা ফিট হয় তখন সেখানে তা ফিট করতে আমরা বিন্দু মাত্র কুণ্ঠিত হইনা, আজকাল আমরা এতটাই আধুনিক যে আধুনিকতার নামে বর্বরতাকেও সহাস্য মুখে মেনে নেই, এমনকি আমরা আমাদের অসামাজিক আচরণকে উচিৎ অধিকার বলে গলা ফাটাই এবং সেইসব রীতি, নিতি, শাস্ত্র এবং সংস্কৃতিকে আদিম, অমানবিক, বর্বর, বৈষম্য মূলক আর কত কি বলে সম্বোধন করতেও দ্বিধা বোধ করিনা কারণ আমরা মডার্ন বলে কথা। কিন্তু লোভ সংবরণ করি কিভাবে বলুন দাদা, তাইত উপহার বা আশীর্বাদের নামে পণ নিতে সেই আদিম রীতি, নিতি, শাস্ত্র বা সংস্কৃতির দোহাই দিতে আমরা মডার্ন মরীচিকাদের সামান্যতম লজ্জা বোধ হয়না। যা হয়ে গেছে তার জন্য আফসোস আর অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবনা, কিন্তু যা হতে পারে তার জন্যে ভবিষ্যৎ আমাদের পানে চেয়ে আছে, আমরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারি, হ্যাঁ আমরা পারি!
আমাদের আত্মরক্ষার জন্য পরিবর্তন করতে হবে, হ্যাঁ, পরিবর্তন করতেই হবে! আমি, আপনি, আমাদেরকে মিলেই এই পরিবর্তনকে আনতে হবে, তবেই পরিবর্তন আসতে বাধ্য, অন্যথায় এ সমাজের ধংস নিশ্চিত, আর এই ধংস থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না, কেউ না। আমরা যদি নিজেদেরকে ধংসের হাত থেকে বাঁচাতে চাই তাহলে আমাদের নিজেদেরকেই সেই পরিবর্তনের কান্ডারি হতে হবে।

কিন্তু কিভাবে? আইন করে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা নিজেদেরকে পরিবর্তন করবো। আমরা যারা বর্তমান সময়ে আছি সে ছেলে হই আর মেয়ে হই, আমাদের সকলকে আজ থেকে অঙ্গীকার বদ্ধ হতে হবে যে আজ থেকে আমারা উপহার, আশীর্বাদ বা অন্য কিছুর নাম করে আমাদের পরিবারের ছেলে অথবা মেয়ের বিয়েতে কোন পণ দেব না নেবও না। আমাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব দের মধ্যে যারাই আশীর্বাদ বা উপহারের নামে পণ দেবেন বা নেবেন তাঁদের অনুষ্ঠানকে আমরা বয়কট করবো, এভাবেই যখন আশীর্বাদ বা উপহারের নামে পণ দেওয়া এবং নেওয়াকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হবে তখন একসময় এই প্রথা আপনা–আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। এই পরিবর্তন একদিনে আসা সম্ভব নয়, তার জন্য সময় লাগবে, কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে একদিন এই প্রথাও সমাজ থেকে বিলুপ্ত হবে। অন্তত আমাদের এই বিশ্বাস বুকে বেধে আজ থেকেই এই লক্ষে এগিয়ে যেতে হবে, অন্যথায় আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের কোনদিনও ক্ষমা করবে না।


full-width