আমাদের জীবনে চলার পথে কতো ঘটনাই না ঘটে যায়,
সব ঘটনাই সময়ের সাথে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা থাকে, যা অমলিন রয়ে
যায়। তেমনি একটি ঘটনা যা আজও আমার মনে অমলিন হয়ে আছে, আর তারই স্মৃতি চারন করতে
গিয়ে আমার এই লেখার সুচনা। আমার এই গল্পটি আমার জ়ীবনের অনেক গুলি ভ্রমনের মধ্যে
সব থেকে স্মরনীয় এক ভ্রমনের গল্প, এক অপরিচিত সহযাত্রীর গল্প, একটি শিশু শ্রমিক
রাহুলের গল্প, নির্যাতীত মহিলা মমিন এর গল্প, বন্ধু সাগর আর স্টিফেনের গল্প, আর
একজন পতিতা মেয়ে বন্ধুর জীবনের গল্প, তাঁদের নিজের মুখে বলা তাঁদের জীবনের চরম
আসহায়ত্বের গল্প, নিদারুন বাস্তবতার গল্প আর আমার প্রতি তাদের কিছু প্রশ্নের গল্প।
৩০শে ডিসেম্বর ২০০৯ইং হটাৎ মনে হল আমি
আরুনাচলপ্রদেশ বেড়াতে যাবো, যেই ভাবা-সেই কাজ, মোবাইলটা হাতে নিয়ে আমার এক পরিচিত
ট্রেভেল এজেন্টকে ফোন করে পরদিনের আর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর ২০০৯ইং গৌহাটীর নাইটসুপারের
টিকিট নিলাম।অচেনা-অজানার উদ্দিশ্যে যাত্রা করা আমার সহচারিত স্বভাব, আমি এই
আনন্দটা মিস করতে চাইনা কখনো। অচেনাকে চেনার-অজানাকে জানার অভিলাশে মন আনন্দে ভরে
উঠে, সেই আনন্দ মনে নিয়ে ৩১শে ডিসেম্বর ২০০৯ইং বিকাল চারটায় ৭দিনের জন্য রওয়ানা হই
আরুনাচলপ্রদেশের উদ্দেশ্যে।
সারাটা রাত মনের আনন্দে মাতাল হয়ে জেগে থাকি,
ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে আমার বাসটি গৌহাটি আইএসবিটিতে পৌছায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে
সকাল ৭টায় ইটানগর এর বাস আইএসবিটির সামনে থেকে যায়, হাতের ঘড়িটি টিক-টিক করে বলে
দিল “আমি কারো জন্যে থেমে নেই, আমার টানে আমি চলি” ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল ৬টা
৪৫মিনিট, হাতে মাত্র ১৫ মিনিট, মিনারেল ওয়াটার দিয়ে মুখ ধুয়ে, এক কাপ চা আর একটা
বিসকিট নিয়ে খেলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য ব্রেকফাষ্ট শেষ করার আগেই বাস এসে গেল, জীবনে
প্রথম কোন দালাল এর সাহায্য নিয়ে বাসের টিকিট নিলাম তাও দু,শ টাকা বেশি দিয়ে,
কিন্তু সিট পেলাম ৩১ নম্বর। যাইহোক, মুহুর্তের মধ্যেই বাস নিজ পথে চলতে লাগল। ১২ঘন্টার
যাত্রাপথ, তাই সকাল ৯টা নাগাদ একটা রোড সাইড হোটেলে কিছু সময়ের জন্য যাত্রীদের
প্রাতরাস সেরে নেবার সুযোগ দিল, আমিও কিছু খাবার কিনে নিলাম রাস্তায় খাবার জন্য আর
সাথে কিছু তাম্বুলও কিনে নিলাম। মিনিট ১৫ এর মধ্যেই বাস তার গন্তব্য পথে চলতে
লাগল, আমিও রাস্তার চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। আমার একটা
মস্ত বড় দোষ আছে আমি যখনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে বিভোর থাকি, তখন আমার চার
পাশের আর্ধেক কথাই আমার কানে আসেনা, আজও আবার সেই ঘটনাটাই ঘটলো, আমার পাশের
সহযাত্রী যে আমাকে উদ্দিশ্য করে কিছু বলছিল তা আমার বোধগম্যই হতনা যদিনা সে আমার
কাধে হাত রেখে আমাকে আমার অস্তিত্বের আভাস দিত, কিছুটা বিরক্তির হাঁসি হেঁসে
জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ বলুন? দু’জনেই মুহুর্তের মধ্যেই পরিচয় পর্বটা শেষ করলাম, তার
পর বেশ কিছুক্ষন দু’জনেই গল্পের মধ্যে ডুবে থাকলাম, লোকটার কথায়-ব্যবহারে মনে হল লোকটা
ভদ্রলোক। গল্পে-গল্পে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলাম। দুপুর দু’টা নাগাদ বাসটি একটা
বাজারের এসে দাড়ালো, দুপুরের খাবার সেরে নেবার জন্য বাস সহচালক সবাইকে অবগত করে
দিল সাথে এও বলে দিল যে রাস্তায় আর কোথাও বাস দাড়াবেনা। আমার সহযাত্রি বন্ধুটি
আমাকে ডেকে বললো, চলুন কিছু খেয়ে নেয়া যাক, আমি মাথা নেড়ে সন্মতি জানালাম। দু’জনেই
বাস থেকে নেমে একটি রোড সাইড হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম। আধঘন্টার
বিরতির পর বাস আবার তার গতিপথে ছুটে চললো। আমি আর আমার সহযাত্রী বন্ধুটি আবারও
আমাদের গল্পের আসরে ডুবে গেলাম। কথায় কথায় আমার সহযাত্রী বন্ধুটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো;...
সহযাত্রীঃ আপনি গেইট পাস নিয়ে এসেছেনতো?
আমিঃ না!
সহযাত্রীঃ আপনি কি গেইট পাসের কথা জানেন না?
আমিঃ হ্যা জানি!
সহযাত্রীঃ তাহলে আপনি গেইট পাস নিয়ে এলেন না
কেন? এখন আপনাকে গেইটেই নেমে যেতে হবে? পুলিশ আপনাকে বিনা পাসে ইটানগর যেতে দেবে
না।
আমিঃ দেখি কি হয়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ইটানগর গেইটে এসে
গেলাম, সবাই বাস থেকে নেমে এক-এক করে নিজের পরিচয় পত্র ইত্যাদি পুলিশকে দেখিয়ে
যেতে লাগলো, ৯-১০জনের পরেই আমি এলাম, আমি আমার ব্যাগ থেকে সব কটি পরিচয় পত্র বের
করে দিলাম পুলিশের হাতে সে এক-এক করে সবকটি পরিচয় পত্র দেখে, আমাকে জিজ্ঞেস করলো...
পুলিশঃ আপনার গেইট পাস কোথায়, সেটা দেখান?
আমিঃ আমার কাছে গেইট পাস নেই?
পুলিশঃ কেন নিলেন না।
আমিঃ আমি একজন ভারতীয় নাগরিক, আর ভারতবর্ষের কোন
রাজ্যে বেড়াতে গেলে কেনো আমাকে পাস নিতে হবে?
পুলিশঃ এটাই আইন। তুমাকে এখানেই নেমে যেতে হবে,
ইটানগর যেতে হলে তুমাকে গৌহাটী ওফিস থেকে পাস নিয়ে যেতে হবে, এই আইন সবাইকে মানতে
হয়।
আমিঃ এই আইন আমি মানিনা, আপনি আমার জাতীয় পরিচয়
পত্র গুলি দেখুন আর আমাকে যেতে দিন, নতুবা আপনার আইন না মানার অপরাধে আমাকে এরেষ্ট
করুন।
আমার কথা শুনে
ঐ পুলিশটা অন্য আরেক পুলিশ কে ডেকে দাড় করিয়ে সে তাঁর বসের কাছে গেলো,
কিছুক্ষন পর আমাকে ডাকলো, আমি ভেতরে যেতেই পুলিশ অধিকর্তা আমার পরিচয় পত্র গুলি
হাতে নিয়ে দেখলো।
পুলিশ অধিকর্তাঃ তুমি কেন ইটানগর যেতে চাও?
আমিঃ বেড়ানোর জন্য।
পুলিশ অধিকর্তাঃ ইটানগরেই কেন?
আমিঃ এখানে কখনো আসা হয়নি তাই।
পুলিশ অধিকর্তাঃ কতদিনের জন্য এসেছো?
আমিঃ সাঁত দিনের জন্য।
পুলিশ অধিকর্তাঃ ঠিক আছে যাও, তবে আর কোন দিন
এলে গৌহাটী ওফিস থেকে পাস নিয়ে এসো।
আমার নাম ঠিকানা সব কিছু লিখে রেখে আমাকে যেতে
দিল। আমি ঐ পুলিশ অধিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে উঠে পড়ি, আমার সহযাত্রী বন্ধুটি
আমার পাশে এসে আমাকে বললো, “আপনার বেশ সাহস আছে দেখছি, বিনা পাসে এলেন তার উপর
পুলিশের সাথে তর্ক করতে লেগে গেলেন” আমি কিছু বললাম না শুধু একটা মিষ্ট হাঁসি
হেঁসে, বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশের সহযাত্রী বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস
করলাম, আর কতটা সময় লাগবে? উনি বললেন এইতো আর মাত্র দু’ঘন্টা। আমি আর কিছু বললাম না চুপ করে বাইরের পৃথিবীর
মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম, অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যাওয়া আকাশের কথা ভেবে মনে
হলো, এই আকাশ যেমন দিনের শেষে অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যায়, আমরা মানুষরাও ভালো কিছু
করার আভিপ্রায়কে মনের মাঝে গুপনে হত্যা করে, খারাপের অন্ধকারে নিজেদের ভালো
গুনগুলিকে হারিয়ে যেতে দেই অনাহাসে, একটু চেষ্টা করলে হয়তো আমরা আমাদের মধ্যে
গুপনে দমে থাকা ভালোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম, কিন্তু আমরা মানুষ নামের এই আজব
প্রানি গুলু জানিনা কিসের লোভে সেই মহৎ কাজটাকে হেলায় দূরে সরিয়ে দেই।হটাৎ আমার
চোখ পড়লো রাস্তার পাশের একটা সাইন বোর্ডের দিকে, দেখলাম দোখানের নামের নিচে লেখা
ইটানগর, পাসের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার পাসের সহযাত্রী বন্ধুটি পাসে নেই,
সামনের দিখে তাকালাম, তাকে আর দেখতে পেলাম না, মনে মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম, যে
মানুষটিকে অতি কাছের মানুষ বলে মনে হলো, সেই মানুষটিযে কতো দুরের তা আর খেয়াল
রইলোনা। মিনিট দুই-একের মধ্যেই বাসটি ইটানগর গঙ্গামার্কেটে এসে দাড়ালো, বাস থেকে
নেমে কিছুটা পথ হেটে এসেই একটি অটোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, পাশে গিয়ে ড্রাইবারকে
জিজ্ঞেস করলাম...
আমিঃ দাদা এখানে হোটেল কোথায় পাওয়া যাবে বলতে
পারেন।
অটোচালকঃ এইতো সামনে গিয়ে হাতের ডান দিকে
দেখবেন অনেক গুলো হোটেল আছে।
আমি অটোচালকে ধন্যবাদ জানিয়ে, সামনের দিকে হেটে
চললাম, কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে অনেক গুলো হোটেল দেখতে পেলাম, একটা হোটেলের রিসিপশনে
গিয়ে দেখলাম একজন মহিলা বসে টিভি দেখছেন...
আমিঃ ম্যাডাম একটা সিঙ্গেল রুম পাওয়া যাবে?
মহিলাঃ হ্যা আছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ফর্মালেটি পুরন করে
নিলাম, রিসিপশনের মহিলাটি ব্যাল টিপতেই ১৪-১৫ বছরের একটি ছোট্ট ছেলে আমার পাশে এসে
দাঁড়ালো, আমার দুটি ব্যাগ তার হাতে নিয়ে আমাকে বললো...
ছোট্ট ছেলেঃ চলুন বাবু?
দু’টি ব্যাগ নিয়ে যেতে ওর কষ্ট হচ্ছিল, তা দেখে
আমি বললাম...
আমিঃ তুমার কষ্ট হচ্ছে! একটা ব্যাগ আমাকে দিয়ে
দাও?
ছোট্ট ছেলেঃ না বাবু, আগে কষ্ট হতো, এখন অভ্যাস
হয়ে গেছে।
লজ্জায় মাথা নিছু করে ওর সাথে রুমে গেলাম, ও
বিছানার পাশে ব্যাগ রাখলো, আমি বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরিরটা এলিয়ে দিলাম। হটাৎ
মনে হলো কে জেন আমার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ খুলে দেকি ছোট্ট ছেলেটি আমার
দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে, আমি ওর চোখে তাকাতে পারলাম না, একটা আনুশোচনা আমাকে
যেন গ্রাস করে নিচ্ছিল, ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম...কি
হয়েছে?ছোট্ট ছেলেটি কিছু বললোনা চুপ-চাপ দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমি বুঝলাম ও
কেন দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে ডাকলাম... এদিকে আসো? সে আমার ডাকে গুরে দাঁড়িয়ে আমাকে বললো,
“যি”, আমি মানি ব্যাগটা খুলে একটা এক’শ টাকার নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম “তুমি
এজন্য দাঁড়িয়ে ছিলে তাই না?” আবারও সে কিছু বললো না, শুধু হেঁসে আমাকে বললো “ধন্যবাদ
বাবু, কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন” আমি ওকে কাছে টেনে বললাম...
আমিঃ তুমি আমাকে বাবু না বলে, দাদা বলে ডাকবে
কেমন?
ছোট্ট ছেলেঃ মাথা নেড়ে হ্যা বললো।
আমিঃ তুমার নাম কি?
ছোট্ট ছেলেঃ আমার নাম রাহুল, কিন্তু সবাই আমাকে
ছটু বলেই ডাকে!
আমিঃ ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, তাহলে
আমি তুমাকে রাহুল বলেই ডাকবো কেমন?
রাহুল(ছোট্ট ছেলে): মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো, আর আমাকে বললো, “আপনি এখন আরাম
করুন, আমি আসি, এই বলে দরজাটা লাগিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই যেন নিরুদ্দেশ্যে বিলিন হয়ে
গেল, আমি আবারও বিছানায় নিজের শরিরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝে পড়ে রইলাম।মনে মনে
ভাবলাম আমি আমার মনের এক অপ্রয়োজনীয় আভিলাস পুরন করার জন্য কতো গুলি টাকা নিরর্থক
খরচ করে এসেছি এখানে, আর এই ছুট্ট নিশপাপ ছেলেটি এই অল্প কিছু টাকার জন্য দিবারাত
কারো দাসত্ব করছে, মনের অনিচ্ছা সত্বেও ফাই-ফরমাস খাঠছে।নিজের প্রতি নিজের মনে
ঘৃনা আর অনুশোচনা নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম তা আর খেয়াল রইলোনা।
বাইরের আতশবাজির বিকট আওয়াজে হটাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে
গেলো, কিছু বুঝে উঠার আগেই রাহুল এসে আমার রুমের দরজায় আঘাত করে করে আমাকে ডাকতে
লাগলো “দাদা! দাদা! দাদা!” আমি দরজা খুলে ওর দিকে বিরক্ত ভাব নিয়ে বললাম “কি হয়েছে?”
সে আমার এই বিরক্তিকর আচরনে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ না করেই আমার হাতে একটি রঙ্গীন
খাম ধরিয়ে, মিষ্টি মুখে “হেপি নিউ ইয়ার” বলে চলে গেল, আমাকে কৃতজ্ঞতা জানানোরও
সুযোগ দিল না। এই বাইরের আমির সাথে ভিতরের আমির যে কতো ওমিল তা যেন প্রতি মুহুর্তে
আরো বিশাল ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, একটি ছুট্ট ছেলের মধ্যে যে শালিনতা-ভদ্রতা আমি
দেখতে পেলাম, তাঁর বিন্দুমাত্রও যে আমার মধ্যে নেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিষন্ন
মনে দরজাটা বন্ধ করে, আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালাম, নিজের কাছে নিজের প্রতিচ্ছবিটাই
যেন অনভিপ্রেত বলে মনে হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত্র ১২টা ১৫মিনিট, মনে হলো
বাইরের এই নতুন পৃথিবীটাকে একবার নিজের মতো করে দেখে আসি, কিন্তু এই ভেশ-ভুশা নিয়ে
যদি বাইরে বেরুই তবে পাগলের উপাধিটা পেতে আর বেশি সময় নেবে না। তাই দ্রুত
স্নানাগারে গিয়ে নিজের মোহাশক্ত অনুভুতিকে ধোয়ে-মোছে পরিস্কার করে নেবার চেষ্টা
করলাম। মিনিট ত্রিশ একের মধ্যে সেজে-গোজে বাবু হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রিসিপসনে এসে
দেখি নবারুনের নবিনত্বকে বরন করে নেবার উৎসবে সবাই ব্যাস্ত, রিসিপসনের মহিলাটি
আমাকে নব বর্ষের অভিবাদন জানালেন, আমিও যথা সম্ভব ভদ্রতার বুলিতে উনাকে অভিবাদন
জানালাম, আস-পাশের সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম, কিন্তু সবার মাঝে আমার দু’চোখ
যেন কাকে খুজে বেড়াচ্ছে, আমি চারিদিকে ঐ মুখটি খুজতে লাগলাম, হটাৎ পেছন থেকে আমার
কানে একটি মিষ্টি সুর বেজে উটলো, ফিরে দেখি এইতো আমার দীর্ঘ প্রতিক্ষার ফল রাহুল।ওকে
কাছে টেনে প্রথমে শুভেচ্ছা জানালাম তারপর খুব ধীরে সরি বললাম, মিষ্টি হেঁসে সে
আমাকে বললো, নতুন বছরের পার্টি করবে না? আমি হেঁসে বললাম, এখানে কার সাথে পার্টি
করবো? আমি তো কাউকে চিনিনা?রিসিপশনের মহিলাটি হেঁসে আমাকে বললেন...
মহিলাঃ আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তবে
আমাদের ছোট-খাটো ফেমেলি পার্টিতে যোগ দিতে পারেন!
আমিঃ ধন্যবাদ, আজ না অন্য আরেকদিন।
মহিলাঃ নতুন বছরের প্রথম দিনে যখন আমার হোটেলে
এসেছেন, সেই সুবাদেই না হয় গরিবের নিমন্ত্রন গ্রহন করুন?
আমিঃ প্লিজ! আমাকে লজ্জা দেবেন না।
রাহুলঃ না দাদা আমি কোন কথাই শুনবোনা, তুমাকে
যেতেই হবে।
মহিলাঃ আমার নিমন্ত্রন না হয় নাই রাখলেন ছোট
ভাইয়ের আবদারটা তো রাখবেন।
আমিঃ ঠিক আছে আমি বাইরে থেকে একটূ ঘুরে আসি,
আপনারা যান।
মহিলাঃ দাড়ান রাহুলকে সাথে নিয়ে যান। বেশি দূর
যাবেন না। বুঝতেইতো পারছেন নতুন বছরের প্রথম রাত কেউ আর হুসে নেই।
আমি রহুলকে সাথে নিয়ে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে
এলাম, আতশবাজির ধ্বনি আর আলোর ঝর্না ধারা দেখে মন উৎফুল্লে ভরে গেল। সামনের রাস্তা
বাধনহীন ছেলে-মেয়েদের আনন্দ উল্লাসে ভরে উটেছে।মনে ইচ্ছে জাগলো তাদের মাঝে হারিয়ে
যাবার, কিন্তু আমাদের মন সব সময় যা চাইবে তাই পাবে এমনটা কখনো হয়না। তাই মনের এই
ইচ্ছাকে, মনের এলবামে সাজিয়ে রেখে রাহুলের হাতটি হাতে নিয়ে সামনের পথে এগুতে
লাগলাম, রাহুল আমাকে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবে দাদা, আমি ওকে বললাম চল ঐ সামনের দিখ
থেকে একটু ঘুরে আসি। সে সুবুধ বালকের মত আমার হাতে-হাত রেখে চলতে লাগলো।কিছুটা পথ
এগুতেই দেখলাম একটা রেষ্টুরেন্ট এর সামনে কিছু ছেলে-মেয়ে অবাদ নৃত্যে মেতে উঠেছে,
তাদের অবস্তা দেখে মনে হলো, পুরান কালের হিংস্র দানবরা তান্ডব নৃত্যে মেতে উঠেছে,
তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে গেলে মহিষাসুর মর্দিনিকে স্বর্গ থেকে মর্তে আসার আহ্বান
জানাতে হবে। যেহেতু আমি নারদ মুনি নই, সেইহেতু সেইকাজটাও আমার দ্বারা হবেনা, তাই
ওদিকে না গিয়ে উলটো পথে চলতে শুরু করলাম, কিছুটা পথ এগুতেই যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম
তাতে আর সন্মুখে যাবার সাহস যোগাতে পারলাম না। রাহুলকে বললাম চল হোটেলে ফিরে যাই
উনারা বোধ হয় আমাদের অপেক্ষা করছেন।
হোটেলের সামনে এসে দেখি মহিলাটি আমাদের
অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন, উনার সাথে হোটেলের পেছনে উনার বাড়িতে গেলাম, উনি আমাকে
বসার ঘরে বসিয়ে রাহুলকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি মুগ্ধ নয়নে উনার ঘরের
কারু-কার্য গুলি দেখছিলাম। দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িটায় হটাৎ চোখ পড়লো, চেয়ে দেখি রাত
১টা ৪৫মিনিট, জীবনে প্রথম এতো রাতে কারো বাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষায় গেলাম, তাও আবার
নিউ ইয়ার পার্টি’তে, কিন্তু এত রাত অবদি কি আর পার্টি চলছে? পেছন থেকে পায়ের শব্দ
ভেসে এলো কানে, ফিরে দেখি মহিলা এসে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলাটি হেঁসে বললেন, কি
দেখছেন? চলুন ভেতরের রুমে চলুন। ভেতরে নিয়ে গিয়ে আমায় একটি সুফায় বসালেন, পাসে
উনিও বসলেন। আমি কিছুটা অস্বচ্ছন্দ বোধ করছিলাম, একজন বাড়িতে নেমন্ত্রন খেতে এলাম
ওতছো, এখনো পর্যন্ত উনার নাম টাই জানা হলো না। তাই উনি কিছু বলে উটার আগেই আমি পরিচয়
পর্বটা শুরু করলাম;...
আমিঃ ম্যাডাম আপনার নামটা জানা হলোনা এখোনো?
মহিলাঃ হ্যা তাইতো! আমি তো হোটেল রেজিষ্টার এ
আপনার সব কিছুই দেখে নিলাম, কিন্তু আপনাকেতো আর আমার পরিচয় দিলাম না। আমার নাম “মমিন”।
আমি এই হোটেলের মালকিন।
আমিঃ আপনি একাই থাকেন?
মমিন(মহিলা): না না একা নই,
আমার দুই মেয়ে এক ছেলে।
এরই মধ্যে পাশের রুম থেকে একটি কুড়ি-একুশ বছরের
মেয়ে এসে বললো, মা আসো সব তৈরি হয়ে গেছে।
মমিনঃ এই আমার বড় মেয়ে “রিচা”।
আমিঃ সৌজন্য মুলক হেঁসে হ্যালো বললাম।
রিচাঃ হ্যালো সার।
আমিঃ আমাকে সার নইয় দাদা বলে ডাকলে খুশি হবো।
মমিনঃ চলুন এখন পার্টি শুরু করা যাক।
আমিঃ সেকি আপনারা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন
বুঝি?
মমিনঃ আরে না না আগে ভেতরে চলুন তারপর দেখবেন
আমাদের পার্টি কি রকম হইয়।
আমিঃ হ্যা চলুন।
রিচা আগে আগে চললো, আমি আর মমিন একসাথেই ভেতরে
গেলাম। ভেতরের রুমে গিয়ে বুঝলাম যে এটা খাবার রুম। মমিন ডায়নিং টেবিলের চেয়ার টেনে
আমাকে বসতে বললেন। আমিও উনার কথা মতো বসে পরলাম। আমার একপাসে রাহুল, আর একপাসে
ষোল-সতের বছরের একটি মেয়ে, তার পাসে রিচা আর আমার ঠীক উলটো দিকে মমিন।রিচা সবার
প্লেটে মিষ্ট দিল। মামিন একপাসে বসা ষোল-সতের বছরের মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন...
মমিনঃ এ আমার ছোট মেয়ে “যেনি”।
আমিঃ আবারও সেই সৌজন্য মুলক হাঁসি-হেঁসে হ্যালো
বললাম।
যেনিঃ মিষ্ট হেঁসে আমাকে হ্যালো বললো।
মমিনঃ নিন শুরু করুন।
আমার ভিষন খোদা পেয়েছিল তাই আর ভদ্রতার বুলি
ধরে রাখতে পারলাম না মিষ্ট খেতে শুরু করেদিলাম। মিষ্ট খেতে খেতে উনার স্বামী আর
ছেলের কথাই ভাবছিলাম, স্বামীর বিষয়ে কোন কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করা সমুচিন হবেনা
ভেবে, ছেলের কথাই জিজ্ঞেস করলাম...
আমিঃ আপনার ছেলেকে দেখছি না যে?
মমিনঃ আমার ছেলের নাম “জিয়েস”, সে গৌহাটিতে
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ক্রিসমাসে এসেছিল দু’দিন থেকেই চলে গেছে।
রিচা আমাদের সবার প্লেটে খাবার দিল, সবাই এক
সাথে খাবার খেতে খেতে নানান বিষয় নিয়ে গল্প করছিলাম, কিন্তু সবার মাঝে একজনকেই চুপ
থাকতে দেখেলাম, সে আর কেউনয় রাহুল, মনে মনে ভিষন কষ্ট হলো, কিন্তু এই নিরবতার
পেছনে বিরাট রহস্যের আভাস পেয়েই চুপ থাকলাম। আমি সল্প খাবার খেয়ে অভ্যস্ত কিন্ত
এখানে সবার চাপা চাপিতে আমার অবস্তা কাহিল। যাইহোক, অবশেষে খাবারের সাথে আমার
যুদ্ধের অবসান ঘটলো, হাত ধুয়ে উটে গিয়ে সুফাতে বসলাম। সবাই এসে আমার পাসে বসলেন,
রাহুল ডাইনিং টেবিল পরিস্কারে ব্যাস্ত।
মমিনঃ পেট ভরেছে তো আপনার? তেমন কিছু আয়োজন করা
হয়নি তো।
আমিঃ এতো আয়োজনের পরও বলছেন এই কথা? তাহলেতো
আমাকে বলতেই হয় যে তৃষ্টা মেটানোর জন্য সমুদ্র দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন তৃষ্টা মিটেছে
কি না!
রিচাঃ মা, দাদার সাথে কথায় পারবেনা তুমি।
মমিনঃ মিষ্টি হেঁসে বললেন, দেখলেন তো আমাদের
পার্টি কেমন হইয়?
আমিঃ হ্যা, খুব ভালোই লাগালো।
মমিনঃ আপনি আসায় আমরাও খুশি হলাম।
আমিঃ তাহলে এখন আসি ম্যাডাম?
মমিনঃ রাহুল, রিচা, যেনি সবাইকে আপন করে নিলেন
আর আমাকে দূরে সরিয়েই রাখলেন!
আমিঃ ঠিক বুঝলাম না কি বলতে চাইছেন?
মমিনঃ আমাকে ম্যাডাম না বলে আন্টি বলে ডাকলেই
খুশি হবো!
আমিঃ ও সেই কথা নিশ্চই, কেন নয়, আপনি আমার
মায়ের বয়সি, আপনাকে আন্টি বলতে আমার দ্বিধা কিসের।তবে আপনি আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন
কেমন।
মমিন আন্টিঃ মিষ্টি হেঁসে, নিশ্চই।
আমিঃ ওনেক রাত হলো আমি এখন তাহলে আসি?
মমিন আন্টিঃ শুভরাত্রি।
রিচা ও যেনিঃ শুভরাত্রি দাদা।
আমিও সবাইকে শুভরাত্রি বলে সেই সমইয়ের জন্য
বিদায় নিলাম। মমিন আন্টি, রিচা ও যেনি আমার সাথে সাথে দরজা অবদি বিদায় জানাতে
এলেন। আমি সৌজন্যের হাঁসি-হেঁসে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমার গন্তব্যের উদ্দিশ্যে
চললাম। যেতে যেতে রাহুলের কথা মনে পড়লো, মনে মনে ভাবলাম শৈশবের জ্বলন্ত প্রদীপ
শিখা কি করে কাল বৈশাকির আগমনি হাওয়ায় নিভে যায় তা আজ স্ব-চুক্ষে দেখলাম। এই দেখার
সাথে না দেখার যে কতো অমিল তা স্বচুক্ষে না দেখে তার সত্যতা অনুধাবন করার সাধ্য
আমার মত নির্বুধ মানুষের নেই।আমি রিসিপসনে গিয়ে আমার রুমের চাবিটা নিলাম, রুমে এসে
কাপড় ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। ঘড়িতে ছেয়ে দেখি রাত ৩টা, দু’দিনের জার্নিতে
শরির ভীষন ক্লান্ত লাগছিল, তাই আর দেরি না করে, বিছানায় গেলাম, আমি টিভি দেখা
ভালোবাসিনা কিন্তু যখনই কোন হোটেলে থাকি তখন টিভিটা খুব বেশিই দেখি, প্রয়োজনে নয়
সময় কাটানোর জন্য, কারন বাড়িতে বই নয়তো লেপটপ দু’টর একটা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমার
সাথে থাকে, এরাই আমার একান্ত আপন, অতি কাছের মানুষ। তাই বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি
দেখতে লাগলাম, মনে মনে ভাবলাম এই পৃথিবীতে একটা বৃহৎ কর্ম প্রবাহ চলছে যার
অধিকাংশের সাথে আমার কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই,পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আমার কেউ
নয়, অথছ তাদের কত কাজ-কর্ম, সুখ-দুঃখ, উৎসব-আনন্দ চলছে। কত বৃহৎ এই পৃথিবী, কত
বিপুল এই মানব সংসার। আমার কাছে আমি যত বড়ই
হইনা কেন, আমাকে দিয়ে সমস্ত বিশ্ব পরিপুর্ন করতে পারবোনা, অধিকংশ জগৎই আমার
অজ্ঞাত, অনাত্মীয়, অমাহীন, তখন একান্ত এই ডিলে জগৎ এর মধ্যে আপনাকে অত্যন্ত খাটো,
একরকম পরিত্যক্ত এবং প্রান্তবর্ত্তী বলে মনে হয়, তখনই মনের মধ্যে একরকমের ব্যপ্ত
বিষাদের জন্ম নেয়, আর মনে উদয় হ্য়... আমি কে? সারা রাত ধরে টিভিটা চললো, ভাবতে
ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম তা আর খেয়াল রইলোনা। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন রিতিমত সকাল
বয়ে গেছে, বিছানা থেকে নেমে প্রথমেই রুমসার্ভিসে ফোন করে চা আর ওমলেট ওর্ডার
করলাম, বেগ থেকে ব্রাশ আর পেইষ্টটা নিয়ে বাথরুমে গেলাম, মিনিট পাচ-একের মধ্যে
ফ্রেস হয়ে নিলাম। টিভিটা চালিয়ে নিউজ দেখতে দেখতেই আমার চা আর ওমলেট এসে গেল,
খাওয়া শেষ করে পায়চারি করার উদ্দিশ্যে রুম থেকে বেরুলাম, রিসিপসনে এসে দেকি রিচা
বসে আছে, দু’জনেই শুপ্রভাত শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম।
আমিঃ মমিন আন্টি কোথায়?
রিচাঃ মা বাজারে গেছেন। কেন? কোন কাজ আছে নাকি?
আমিঃ না, না তেমন কিছু নয়।
রিচাঃ ঘুম কেমন হলো দাদা।
আমিঃ ভালোই হলো। রাহুল কোথায়।
রিচাঃ সে মা’র সাথে বাজারে গেছে।
আমিঃ ও আচ্ছা। একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি বলে
বেরিয়ে গেলাম।
হোটেলের বাইরে বেরুতেই দেখি নতুন বছরের প্রথম
সকালের সুর্যালোক যেন দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গন করার অপেক্ষায় ছিল, উৎতপ্ত
রোধের মধ্যে রাস্তার একপাস ধরে হাটতে শুরু করলাম, পথ ভ্রান্ত বিভ্রান্ত পথিক যেমন
অন্ধকার’কে অভিবাবক মেনে চলতে থাকে, আমিও ঠিক তেমনি অচেনা-ওজানা শহরের মধ্যে চলতে
শুরু করলাম। অনেকটা পথ হেটে একটি চায়ের দোখানের সামনে গিয়ে দাড়ালাম, এককাপ চা আর
সাথে একটা সিঙ্গারা খেলাম, পাশের দোখান থেকে দুটি পান কিনে একটি খেলাম আর একটি
পকেটে রেখে দিলাম। তখন ঘড়িতে সকাল ১০টা আমি হোটেলের উদ্দিশ্যে ফিরলাম, হাটতে হাটতে
মনে হলো, অনেকটা পথ হেটে আজ হয়তো আমি পথিক হতে পেরেছি, হয়তো আমি রুপকথার সেই অন্ধ
রাজকুমার, নাগালের মধ্যেই রাজ্যপাট কিন্তু সবই অন্ধকার। হোটেলে এসে দেখি রিচা বসে
বসে টিভি দেখছে,...
আমিঃ এখনো আন্টি আসেনি?
রিচাঃ মা আসতে ১১টা বাজাবে।আপনি কোথায়
গিয়েছিলেন?
আমিঃ এইতো একটু সামনে থেকে ঘুরে এলাম।
রিচা আমাকে চাবিটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আজ কোথাও
যাবার প্লেন আছে নাকি? আমি বললাম বিশেষ কোন প্লেন নেই, দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
রিচা’কে আসি বলে রুমে চলে গেলাম, টিভি চালিয়ে বিছানায় বসে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে
দেখি অনেক গুল মিসকল এসেছে বাড়ি থেকে, বাড়িতে একটা ফোন করলাম, তারপর বেগ থেকে কাপড়
বের করে স্নানে গেলাম, স্নান সেরে তৈরি হয়ে ঠিক সকাল ১১টায় ব্যাগ, ক্যামারা
ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম অজানা গন্তব্যের উদ্দিশ্যে।
রিসিপসনে গিয়ে দেখি মমিন আন্টি বসে আছেন, আমি
চাবিটা উনার হাতে দিলাম...
মমিন আন্টিঃ কোথায় যাবে?
আমিঃ দেখি কোথায় যাই?
মমিন আন্টিঃ অসুবিধে হলে রিচা বা যেনি’কে সাথে
নিয়ে যাও!
আমিঃ না না লাগবেনা, আমি একাই পারবো।
মমিন আন্টিঃ তোমার মোবাইল নম্বরটা দাও আর আমার নম্বরটা
রাখো কোন প্রয়োজন হলেই ফোন করবে।
আমিঃ ধন্যবাদ। এখানে দেখার মতো কি কি আছে।
মমিন আন্টিঃ আছে অনেক কিছুই। গঙ্গা লেইক,
বায়োলজিকেল পার্ক...... ইত্যাদি অনেক কিছুর কথা বললেন। বাস বা অটো নিয়ে যেতে হবে।
আমিঃ ধন্যবাদ। এখানে অটো কোথায় পাওয়া যাবে?
মমিন আন্টিঃ এইতো হোটেল থেকে বেরিয়ে, বামদিকে একটু
সামনে গেলেই অটো স্ট্যান্ড আছে।
আমিঃ ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম যাত্রা পথের
সন্ধানে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে সামনের একটা পান দোখান থেকে
পান কিনলাম, একটা মুখে দিয়ে বাকি গুলো ব্যাগে রেখে দিলাম। কিছুটা হেটে সামনের অটো
স্ট্যান্ডে গিয়ে একটা অটোকে জিজ্ঞেস করলাম গঙ্গা লেইক যাবে, সে না করে দিল, আমি
অন্য অটো খুজছিলাম, এমন সময় পেছন থেকে একটা মধ্য বয়সি ছেলে এসে বললো আমার সাথে
আসুন, আমি ওর সাথে সাথে গেলাম, সে তার অটোর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে বললো, এখানের কোন
অটোই যাবে না, এখানে সব রানিং অটো, আপনাকে রিজার্ব অটো নিয়ে যেতে হবে, আর তার জন্য
আপনাকে একটু সামনে যেতে হবে সেখান থেকে আপনি রিজার্ব অটো পেয়ে যাবেন।জানিনা কেন
লোকটাকে দেখে বিশ্বাস করতে মনচাইলো, যদিও অচেনা-অজানা শহরে বিশ্বাস শব্দটা অতি
দুর্লব কিন্তু তবুও আমার মন ওকে বিশ্বাস না করে পারলোনা। তাই আমি ওকে জিজ্ঞেস
করলাম আপনি যাবেন? অটোচালকঃ না বন্ধু আমিও যেতে পারবোনা।
আমিঃ একটু কথা বলেই দেখুন না কি হয়।
অটোচালকঃ ঠিক আছে চলুন কথা বলে দেখি।
সে আমাকে নিয়ে অটো সিন্ডিকেটে গেল সেখানে গিয়ে একজন
ভদ্রলোকের সাথে কথা বললো। আমাকে দেখিয়ে বললো যে বাইরে থেকে আমার এক বন্ধু এসেছে
এখানে বেড়াতে আমি ওর সাথে অটোনিয়ে যাচ্ছি আপনি আমার সিরিয়েলটা অন্য অটোকে দিয়ে
দিন। লোকটি জানিনা কি বুঝলো আমার দিকে একবার চেয়ে বললো ঠিক আছে যাও।ফিরে এসে সে
আমাকে অটোতে বসিয়ে বললো প্রথম কোথায় যাবেন...
আমিঃ প্রথম গঙ্গা লেইক চলো, তারপর অন্য যায়গায় যাওয়া
যাবে।
অটোচালকঃ ঠিক আছে চলুন।
আমিঃ আপনাকে কত দিতে হবে তাতো কিছু বললেন না?
অটোচালকঃ আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন, আর আমি
আপনাকে যেহেতু বন্ধু বলেছি তাই আপনার সাথে টাকার কোন সম্পর্ক নয়। আগে আপনি সবকিছু
গুরে দেখেনিন তারপর না হয় যা দেবার দিয়ে দেবেন।
আমিঃ না, না এটা আপনার পেশা, সেটা কি করে হয়?
অটোচালকঃ মিষ্টি হেঁসে বললো আমি কি বলেছি যে
আপনার কাছ থেকে টাকা নেব না? অন্য কেউ হলে হয়তো দর-দাম করেই অটোটা ছারতাম কিন্তু
বন্ধুর সাথে তো আর দর-দাম খাটেনা।
আমিঃ আমি মিষ্টি হেঁসে বললাম আপনিতো বেশ মজার
মানুষ। আপনার নাম কী?
অটোচালকঃ আমার নাম সাগর।
আমিঃ আপনি এখানেই থাকেন।
সাগর (অটোচালক): আমার বাড়ি গ্রামেই এখানে আমি
আমার স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভাড়া থাকি। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ভাই-ভোনরা থাকে।
গ্রামে কাজ করে পরিবার চালানোর কোন ব্যাবস্তানেই তাই শহরে এসেছিলাম কাজের সন্ধানে,
এখানে এসেও কোন কাজ পেলাম না অবশেষে অটোচালক হয়ে গেলাম।
আমিঃ আপনার পড়াশুনা কতদুর?
সাগরঃ পিউ পাশ।
দু’জনেই গল্প করতে করতে গঙ্গালেইকে পৌছে গেলাম,
প্রায় আধঘন্টার পথ, কিন্তু বোঝাই গেলনা। সেখানে গিয়ে সাগর আমাকে টিকিট কাউণ্টারে
নিয়ে গিয়ে টিকিট করে দিল, সে একজনের জন্য টিকিট নিতে চাইলো, আমি দু’জনের জন্যই
নিলাম। তাকে সাথে নেওয়ার পেছনে আমার কোন উদারতা নেই নিজের স্বার্থেই ওকে সাথে নিয়ে
গেলাম, প্রথম স্বার্থ আমি কিছুই চিনিনা আর দ্বিতীয় স্বার্থ আমার সাথে কেমেরা আছে
কিন্তু ফটোতোলার মতো একজন মানুষ চাই আর সে কাজটা সাগর ভালো করেই করতে পারবে সেটা
আমার বিশ্বাস ছিল। তাই ওকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া। ভেতেরের মনোরম প্রকৃতিক দৃশ্য
দেখে আমি অভিভোত, প্রশন্ন মনে উপভোগ করতে লাগালাম প্রকৃতির অমৃতরস। আকাশের মেঘলা
বসন, প্রানবন্ত নির্মল বাতাস আর পাখিদের নিরলস কুঞ্জনে যেন প্রকৃতি পুর্নতা লাভ
করেছে, মনে মনে মনকে বললাম তুমি যা গড়েতুল তা শুধু তুমার জন্যই আর প্রকৃতি যা গড়ে
তুলেন তা সকলের আনন্দের জন্য। প্রকৃতির এই নিপুন সৌন্দর্য সম্ভার দেখে এতোটাই
স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার সাথে আর একজন মানুষ আছে সেকথা আমার বোধগম্যই
হতোনা যদিনা সেই ভালো মানুষটি আমার দৃষ্টি আকর্ষন করতো...
সাগরঃ আপনি ক্যামারা নিয়ে আসেন নি?
আমিঃ সম্ভ্রম ফিরে পেয়ে, হ্যাঁ এনেছি।
ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে আমি কিছু ফটো
তুলেনিলাম, ক্যামেরাটি সাগরের হাতে দিয়ে ওকে কিছু ফটো তুলতে অনুরোধ করলাম। লেইকের
পাশের পথ ধরে হাটতে হাটতে দু’জনেই গল্প করতে শুরু করে দিলাম। সাগরের সাথে কথা বলে
আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। আমি সাগরকে বোট রাইডিং এর কথা বললাম, সে আমাকে নিয়ে ঘাটের
পাশে গেল সেখানে গিয়ে আমি টিকিট নিলাম, একটা ছুট্টছেলে আমাদের দিক নির্দেশ করে
দিল, আমরা দু’জনেই বুটে উঠে বসলাম। পা-চালিত বুট, আমি আর সাগর দু’জনেই পা-দিয়ে বুট
চালানোর কাজ করছিলাম। সাগর ক্যামেরা নিয়ে ফটো তুলতে ব্যাস্ত আর আমি প্রকৃতির মনোরম
দৃশ্য উপভোগে ব্যাস্ত। আমি সাগরের হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে ওর কিছু ফটো
তুলেনিলাম। আমরা প্রায় দু’ঘন্টা সময় বুটিং করলাম। বুটিং সেরে আমরা দু’জনে গল্প
করতে করতে লেইক থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম দুপুর দু’টা
বাজে। সাগরকে জিজ্ঞেস করলাম এখন আর কোথায় যাওয়া যায়।
সাগরঃ বায়োলজিকেল পার্কে যাওয়া যেতে পারে!
আমিঃ ঠিক আছে সেখানেই চলো।
সাগরঃ এদিকে এই দু’জায়গাই আছে ঘুরে দেখার মতো।
আর তেমন কিছু এদিকে নেই।
আমিঃ ঠিক আছে আজ এদিকটা শেষ করে নেব, কাল
অন্যদিকে বেরুব।
সাগরঃ আপনি ক’দিন থাকবেন।
আমিঃ বন্ধুকে আপনি নয়, তুমি বলতে হয়।
পাঁচ-ছয়দিন থাকার ইচ্ছে আছে দেখা যাক কি হয়।
সাগরঃ মিষ্টি হেঁসে ঠিক আছে।
আমরা দু’জনের মধ্যে গল্পের আসরটা বেস ভালোই
চলছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা দু’জনেই খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। গল্প করতে
করতে আমরা বায়োলজিকেল পার্কে এসে গেলাম। সাগর অটোটা পার্ক করে আমাকে নিয়ে টিকিট
কাউন্টারে গেল সেখান থেকে দু’জনের জন্য টিকিট নিলাম। সামনে একটা ছোট-খাটো দোখান
দেখলাম, আমার চা খেতে ভিষন মনচাইছিল, তাই সাগরকে নিয়ে সেই দোখানে গেলাম, আমি দুটি
চায়ের অর্ডার করলাম...
সাগরঃ আমি চা খাইনা।
আমিঃ তাহলে অন্য কিছু খাও।
সাগরঃ না না আমি কিছু খাবোনা।
আমিঃ না বললেই চলবে, কিছু খেতেই হবে। আমি চেয়ার
থেকে উঠে গিয়ে দেখলাম কি কি আছে খাবার মতো, দেখলাম সেখানে চিপস ছারা তেমন কিছু নেই
যা এই মুহুর্তে খাওয়া যায়। তাই এক পেকেট চিপস নিয়ে নিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে
জলযোগ সেরে আমরা দুজনেই পার্কের ভেতরে চলে গেলাম। আমরা ঘুরে ঘুরে চারদিকে
পশু-পাখিদের অবাদ বিচরন দেখতে লাগলাম। একটা জায়গায় গিয়ে দেখলাম বেশ কিছু বানর
ঘোরা-ফেরা করছে। হটাৎ একটা মনোরম দৃশ্য আমার চোখে পড়লো, দেখলাম একটা বানরনী তার
বাচ্চাকে বুখে আখড়ে ধরে একডাল থেকে অন্য ডালে নিয়ে পালাচ্ছে আর তার পেছন-পেছন আরও
অনেক গুলি বানর ছুটে চলেছে, অনেকটা সময় ছোটা-ছোটি করার পর বানরনী তার বাচ্চাটাকে
একটা জায়গায় রেখে সামনে স্ববলে দাঁড়িয়ে আছে আর যে’ই তার কাছে আসার তাকেই প্রান-পনে
ধাওয়া করে তারিয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমি সম্পর্ন বিস্মিত হলাম। আমি যদিও কোন
পশু বিশেষঙ্গ নই, তথাপিও আমার সাম্যক জ্ঞানে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে এটাই বুঝলাম
যে, ঐ বানরনীটি তার বাচ্চাটাকে যাতে অন্য কোন বানর বা বানরনী তার কাছ থেকে কেড়ে
নিতে না পারে তারজন্য আপ্রান চেষ্টা করে চলেছে। অবশেষে ঐ বানরনীরই জয় হলো, বেগ না
পেয়ে সবাই ফিরে চলে গেল। আমি এতটাই বিস্মিত হলাম যে মনের ভাষাকে লেখায় রুপদেবার
যোগ্য ভাষাই খুজে পাচ্ছিনে। আমরা যারা নিজেদেরকে মানুষ বলে দাবি করে থাকি অতছ
প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে ভ্রুনের লিঙ্গ নির্ধারন আর ভ্রুন হত্যার মতো জঘন্য কাজে
লিপ্ত হতে সামান্যতম দ্বিধা বুধ করিনে, সেই আমরা কিসের দুহাই দিয়ে এই মানুষ নামের
উপাধি নিয়ে এতো বড়াই করি? আমরাতো এই বানরদের চেয়েও অতি জঘন্য জীব, আমরাতো ইশ্বরের
সৃষ্ট এক নিকৃষ্ট জীব এর থেকে বেশি কিছু বলে আমার মনে হয়না। আমার মনের আবেগপুর্ন
কথা গুলি আমি সাগরকে বললাম, জানিনা সাগরকি বুঝল, সে আমাকে বললো মন খারাপ করে কি
হবে বলো, আমরা যখন অপরাধ করি তখন তার পরিনতি বুঝার চেষ্টা করিনে, আর যখন বুঝি তখন
অনেক দেরি হয়ে যায়। সাগর আমার মনের গতি করানোর জন্য নানান কথা বলতে লাগলো, আর
চারিদিক ঘুরিয়ে আমাকে সবকিছু দেখাতে লাগলো। আমরা বিকাল চারটা নাগাদ বায়োলজিকেল
পার্ক থেকে বেরুলাম। সাগর আমাকে জিজ্ঞেস করলো এখন কোথায় যাবো, আমি বললাম এখন আর
কোথাও নয়, সোজা গঙ্গা মার্কেট চলো। রাস্তায় যেতে যেতে সাগর আমার ব্যাপারে অনেক
কথাই জিজ্ঞেস করলো, আমি নিরবে ওর কথার উত্তর দিয়ে গেলাম।
সাগর তার অটোটা ঠিক আমার হোটেলের সামনে পার্ক
করে আমাকে নামিয়ে দিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ভাড়া কত দিতে হবে?
সাগরঃ তুমি বুঝে শুনে দিয়ে দাও।
আমিঃ না না তুমি বলো আমার এসবের কোন আইডিয়া
নেই।
সাগরাঃ আমি বলতে পারবোনা, তুমার যা মন চায় দিয়ে
দাও।
আমিঃ পাঁচ’শ টাকা দিলে পুশাবে।
সাগরঃ বললামতো তুমার যা ইচ্ছে দিয়ে দাও।
আমিঃ ছয়’শ টাকা ওর হাতে দিয়ে বললাম কম হলে চেয়ে
নিয়ে নিও।
সাগরঃ টাকাটা না গুনেই পকেটে ডুকিয়ে বললো তাহলে
আমি আসি।সন্ধ্যার পর দেখা হবে।
আমিঃ এখন কোথায় যাবে।
সাগরঃ এখন আর কোথাও নয়, বাড়িতে চলে যাবো।
আমিঃ ঠিক আছে চলো ভাঁত খেয়ে নেই।
সাগরঃ না না আমি খাবো না।
আমিঃ হেঁসে বললাম ভাঁতও খাওনা না কি? কোন কথা
নয়, আমার সাথে চলো দু’জনে একসাথে খাবো।
সাগরঃ কিন্তু...
আমিঃ কোন কিন্তু নয়।
আমি সাগরকে নিয়ে সামনের একটা হোটেলে গেলাম,
ম্যানু দেখে খাবার ওর্ডার করলাম। সাগর হটাৎ আসছি বলে উঠে বাইরে চলে গেল,
দু’মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে স্বস্তানে বসে পড়লো। আমরা দু’জন আবার গল্পের মধ্যে
ডুবে গেলাম, সাগর আমাকে আমার বিষয়ে সব কিছু জিজ্ঞেস করলো, একেবারে নিপুন
বিশেষঙ্গের মত কুটি-নাটি সব বিষয়েই তথ্য আহরন করে নিল, ওর প্রশ্নগুচ্ছ শুনে আমার
মনে হলো যেন কোন এক বিখ্যাত লেখক আমার জীবনি রচনার উদ্দিশ্য নিয়ে আমার সাথে আহার
করতে বসেছেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমাদের খাবার এসে গেল, সাগর আমার থালায় খাবার
বেড়ে দিতে লাগলো, তার ভাব দেখে আমার মনে হলো আমি তার আথিতেয়ত্ব গ্রহন করেছি আর সে
যথাসাধ্য আমাকে সৌজন্যতা প্রদর্শন করার অভিপ্রায় করে চলেছে। আমি নিত্যান্তই লজ্জা
বোধ করলাম, যে একজন মানুষ ক্রমাগত আমার প্রতি তার অতিভ প্রেম আর সৌজন্যতা প্রদর্শন
করে চলেছে, আর আমিও একজন মানুষ হয়ে কেবল তার ব্যক্তিত্বকে আহরন করে চলেছি। এই সব
কিছুর মাঝে নিজেকে বড়ই অনভিপ্রেত বলে মনে হতে লাগলো। তাই আমি নিজের ভাবটাকে কাটিয়ে
উঠলাম, আর সাগরকে জিজ্ঞেস করলাম...
আমিঃ তুমার বাড়িতে কে কে আছেন?
সাগরঃ মা আর দু’বোন আমি আমার স্ত্রী আর একটা
মেয়ে। আমি যখন ১০বছরের ছিলাম তখনই বাবা মারা গেছেন।
আমিঃ তোমার বাবা কি করতেন।
সাগরঃ কিছুই না সারাদিন মদ খেত আর রাস্তায় পড়ে
থাকতো।
আমিঃ তাহলে তুমাদের পরিবার কি করে চলতো?
সাগরঃ মা যখন যা পেত সেই কাজই করতো। অনেক কষ্ট
করে আমাদের বড় করেছে, পড়াশুনা করিয়েছে।
আমিঃ তুমার পড়াশুনা কতটুকু?
সাগরঃ আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। আমি পিউ
পাস করার কিছুদিন পরই মা ভিষন অসুস্ত হয়ে পড়েন, পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর
এসে পড়ে। আমি কাজের খোজে শহরে আসি এখানে এসে কিছুদিন লেবারের কাজ করলাম, দিনরাত
পরিশ্রম করে কাজ করে পরিবার ছালানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। মা আমাকে পড়ানোর জন্য বাড়ির
যে জায়গাটা আমাদের অবশেষ সম্বল ছিল সেটা বিক্রি করে দিতে চাইছিল, কিন্তু আমি তা
বিক্রি করতে দিলাম না, কারন এটাই আমাদের শেষ সম্বল ছিল। আমি মাকে কথা দিলাম যে
কাজের মাঝেও লেখা পড়া চালিয়ে যাবো। তাই এখানে এসে কাজের ফাকে ফাকে পড়াশুনাও চালিয়ে
যেতে লাগলাম। কিন্তু স্তায়ি কোন কাজের সন্ধান না পেয়ে আমি ভাড়াতে অটো চালাতে শুরু
করে দিলাম।
আমিঃ তুমার মতো একজন মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে
বেশ ভালোই লাগছে। তুমার কাছ থেকে আমি জীবনের করুন সত্য জানতে পারছি যা হতো আমি
কোনদিনও জানতে পারতাম না। আমরা যারা সৌখিনতার আস্ফালনে বড় হয়ে উঠেছি, সেই আমাদের
চাহিদা নামক তৃষ্ণার তৃপ্তি ঘটেনা কোনদিনও, আমাদের কাছে তুমাদের এই বাস্তবতা কেবল
গল্প মাত্র, এর থেকে বেশি কিছুই নয়।
সাগরঃ সেটাই স্বাভাবিক, কারন আমরা বাধ্য তাই
আমাদের এই বাস্তবতার মধ্যেই জীবন কাটাতে হয়। তুমাদের তো কিছুর অভাবনেই তাই এসব
ভেবে লাভ কি বলো।
আমিঃ কথাটা লাভ বা লোকসানের নয়, আমরা যদি
আমাদের চারপাশের করুন বাস্তবতাটাকে উপলব্ধি করতে পারতাম তা হলে হয়তো আমাদের
যুব-সমাজ দিন-দিন যে পথে পরিচালিত হয়ে চলেছে সেটা হয়তো ঘটতোনা। যাই হোক তুমার কথাই
বলো।
সাগরঃ আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর
একটা চাকুরির জন্য অনেক ছোটা-ছুটি করলাম, কিন্তু কোন উপায়ান্তর ঘটলোনা। অবশেষে
অটোচালনোতেই পুর-পুরি মনোনিবেশ করলাম। বেশ ভালোই চলতে লাগলো। এরই মধ্যে একটি বোনের
বিয়ে দিলাম। আমার অতিকষ্টার্যিত সার্টিফিকেট গুলি অবশেষে আমার একটা কাজে লাগলো,
সার্টিফিকেট গুলির বিনিময়ে ব্যাঙ্ক থেকে বেকার লোন নিয়ে একটা নতুন অটো কিনলাম। তার
কিছুদিন পর আমার আর একটি বোনের বিয়ে দিলাম। দু’বছর হলো আমি বিয়ে করলাম। আমাদের
এখানেতো মেয়েরাই মা-বার সাথে থাকে তাই মা বোনদের সাথে গ্রামের বাড়িতেই থাকেন, আমি
প্রতি সাপ্তাহে একবার আমার পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাই সবার সাথে দিন কাটিয়ে
বিকেলে বা পরদিন চলে আসি। এখন আমাদের দিন একটু ফিরেছে, আমার এখন তিনটি অটো আছে।
একটা আমি নিজেই চালাই আর বাকি দু’টি ভাড়াতে যায়। এই হলো আমার জীবনের কাহিনী।
আমিঃ তুমিই প্রকৃত মানুষ, আমরা তো শুধু নামে
মানুষ, আমাদের জীবনের কোন অর্থবহুল দিক নেই।
কথায় আমাদের খাবার পর্বটাও শেষ হয়ে গেল, হাত
ধুয়ে বিল দিয়ে, আমরা দু’জন বাইরে এলাম। সামনের দোখান থেকে আমার জন্য পান নিলাম।
সাগর আমাকে তার বাড়িতে যাবার জন্য নেমেন্ত্রন জানালো। আমি ওকে কথাদিলাম ওর বাড়িতে
যাবো। দু’জনের মধ্যেই ফোন নম্বর আদান-প্রদান হলো, সন্ধ্যারপ্র আবার দেখা হবে
এইটুকু বলে সাগর আমাকে হোটেলের সামনা অবদি এগিয়ে দিয়ে সে বাড়ি চলে গেল। আমি
রিসিপসনে এসে দেখি মমিন আন্টি বসে আছেন, আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন...
মমিন আন্টিঃ কি বেপার এতো গুলি ফোন করলাম তুমি
ফোন ধরলে না যে?
আমিঃ একটু বিস্মিত হয়েই মোবাইলটা হাতে নিয়ে
দেখি ওনেক গুলি মিসকল, আন্টিকে সরি বললাম।
মমিন আন্টিঃ আমি ভিষন চিন্তা করছিলাম তুমার
জন্য, না জাই কি হলো।
আমিঃ না না কোন সমস্যাই হয়নি, অটো নিয়ে
গিয়েছিলাম, লোক্টা বেশ ভালোই ছিল।
মমিন আন্টিঃ কোথায় কোথায় গিয়ে ছিলে।
আমিঃ এইতো গঙ্গালেইক আর বায়োলজিকেল পার্ক।
মমিন আন্টিঃ কতো টাকা নিল?
আমিঃ ছ’শ টাকা নিয়েছে।
মমিন আন্টিঃ কি বলছো এত কম নিল নাকি।হাজার
টাকার কমতো নেবার কথা না যাই হোক কম নিলেতো ভালোই। চাবি দিয়ে বললেন রুমে গিয়ে
ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমিঃ না আন্টি লাগবেনা আমি বাইরে থেকে খেয়ে
এসেছি, আপনি রাহুলকে দিয়ে একটু ঠান্ডা জল পাঠিয়ে দিন।
মমিন আন্টিঃ রাহুলতো বাজারে গেছে আমি আন্য কাউকে
দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর রাতে কোথাও কেয়ে এসোনা। আমাদের সাথেই খাবে কিন্তু।
আমিঃ ঠিক আছে আন্টি বলে রুমে চলে গেলাম।
রুমে গিয়ে প্রথমেই টিভিটা চালিয়ে দিলাম, কাপড়
ছেড়ে বিছানায় শরিরটা এলিয়ে দিয়ে টিভি দেখতে লাগলাম, দরজাটা খুলাই ছিল একটা ছেলে জল
নিয়ে এলো, আমার হাতে জলের বোতলটা দিয়ে চলে গেল। আমি জল খেয়ে, দরজাটা লাগিয়ে আবার
বিছানায় এসে গেলাম। বালিশে মাথা দিয়ে টিভি দেখেতে লাগলাম। হটাৎ সাগরের কথা মনে পড়ে
গেল, মনে মনে ভাবলাম প্রকৃত সংগ্রামী পুরুষ বলতে যা বুঝাই, সাগর তাই, আমরাতো এই
মানব মহাসমুদ্রে বুদ-বুদের মতো ভেসে চলা প্রানী বৈকি আর কিছুই নই। অতছ আমরা
কৃতিত্বের অধিকারি হবার চেষ্টা চালিয়ে যাই আজীবন। যে লোক ধনী, ঘরের চেয়ে তাদের
বাগান বড় হয়ে থাকে। ঘর অত্যাবশ্যক, বাগান অতিরিক্ত, না হলেও চলে। আসলে সম্পদের
উদারতা অনাবশ্যকই নিজেকে সপ্রমান করতে ব্যস্ত থাকে, আর সাগরের মতো লোকরাই যোগযোগ
ধরে তা প্রমান করে দেয়।
চলবে......
0 মন্তব্যসমূহ