| বিকর্ণ |


মহাভারতকে কেন্দ্র করে না জানি কতই বা নাটক লেখা হয়েছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের কাছে এটি বিচার্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কম সময়ের জন্য এমন সব ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করে তাদের সাথে ন্যায় করা হয়নি; তাদের মধ্যে একজন ব্যক্তিত্ব হলেন "বিকর্ণ"। বিকর্ণ মহাভারতের গাঁথায় এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি, আজীবন ধর্মের পক্ষে ছিলেন। যেখানে অন্যান্য কৌরবেরা অধর্মী হবার কারণে নিজেদের পরিবারের বিরুদ্ধেই যড়যন্ত্র আটছিল।
সেখানে বিকর্ণ'ই একমাত্র ব্যক্তি যে, তাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়ে ধর্ম স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরেও মহাভারতের গাঁথায় তাঁর স্থান বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
সত্ত্বা ও অহংকারের বশে থাকা অন্যান্য কৌরব ভাইদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদেরকে বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ায় মহাভারতের যুদ্ধে বিকর্ণ সমেত সকল ভাই মারা যায়। যাদের রক্তে কুরুক্ষেত্রের ভূমি লাল হয়ে যায়।
যখনই কৌরবদের নাম নেওয়া হয় তাঁর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় দুর্যোধন অথবা দুঃশাসনেরই নাম নেওয়া হয়ে থাকে।
বিকর্ণ ধৃতরাষ্ট্রের তৃতীয় সন্তান। যার শিক্ষা দীক্ষা কীপাচার্য, দ্রোণ ও পিতামহ ভীষ্মের তদারকিতে সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু মহাভারতের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে চোখের অন্তরালেই রাখা হয়। ভাগবত গীতায় বিকর্ণ'কে একজন মহান যোদ্ধা রুপে বর্ণনা করা হয়েছে।
কৃষ্ণের মতানুসারে, কৌরবপক্ষে অশ্বত্থামা ও কর্ণের পরে যদি কেউ মহান ধর্নুধর থেকে থাকে সে হল বিকর্ণ। কিন্তু মহাভারতে একলব্য, অশ্বত্থামা, কর্ণ, অর্জুন, উপস্থিতির ক্ষেত্রে বিকর্ণ'কে সর্বদাই এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে। ডঃ পি.বি নাথ দ্বারা লেখা ভগবত গীতাতেও বিকর্ণ'কে একজন মহান ধর্ণুধর রুপে বর্ণনা করা হয়েছে।
দ্রোণাচার্যের কাছে থেকে শিক্ষা লাভের পর যখন গুরুকে দক্ষিণা দেওয়ার সময় আসে তখন কৌরবেরা জিজ্ঞাসা করে গুরু দক্ষিণা রুপে কি চাই! তখন দ্রোণাচার্য ধ্রুপদ রাজের রাজ্য আক্রমণ করে জিতে সেই রাজ্য গুরু দক্ষিণা রুপে দিতে বলে। গুরুর কথা শুনে কৌরবেরা ধ্রুপদের রাজ্য আক্রমণ তো করে, কিন্তু ধ্রুপদের সেনাবাহিনীর কাছে তাদের বড় হার হয়।
এই যুদ্ধে বিকর্ণও অংশ নেন এবং সকল রকম প্রচেষ্টা করে গুরুকে দক্ষিণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কৌরবদের হেরে যাওয়ার পর একই গুরু দক্ষিণা পান্ডবদের কাছে চায়, তখন পান্ডববেরা ধ্রুপদের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে গুরু কে গুরু দক্ষিণা প্রদান করে।
এই যুদ্ধে বিকর্ণেরও ভূমিকা কম নয়; যদি শুধু কৌরবেরাই ধ্রুপদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হত তাহলে বিকর্ণকেই মহান ধর্ণুধর রুপে বিবেচনা করা হত।
পাশা খেলায় যখন পান্ডবেরা প্রায় সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিল। তখন পান্ডবেরা ঝোঁকের বশে এসে নিজেদের স্ত্রী দ্রৌপদীকেও খেলায় পাশা হিসেবে রেখে হেরে যায়, তখন দুর্যোধন দ্রৌপদীর দ্বারা করা অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সভা কক্ষেই সবার সামনে দুঃশাসনকে আদেশ দিয়ে বস্ত্রহরণ করিয়ে বসে।
দুঃশাসনের দ্বারা করা বস্ত্রহরণ সভার সকলে দেখতে থাকে। যেখানে পান্ডবেরা, ধৃতরাষ্ট্র, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম, বিদুর সকলেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউই এই অধর্মের বিরুদ্ধে নিজেদের আওয়াজ তোলেনি।
এখানে বিকর্ণই একমাত্র কৌরব ছিল যে, আপন ভ্রাতাদের এই অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল সেইসাথে একদম শেষ পর্যন্ত দুর্যোধন ও দুঃশাসনকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন যে, এটি করা একদমই অধর্ম।
তাছাড়া কুলবধুর এমন অপমান কখনোই করা উচিত নয়, এতে বংশের লোপ ঘটে। কিন্তু তারপরেও বিকর্ণের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তারপরেও বলা যায় যে, মা গান্ধারীর সকল পুত্রই অধার্মিক ছিল এই নয়; তার গর্ভ থেকে আদর্শবান ধার্মিক পুত্রের ও জন্ম হয়েছিল, বিকর্ণ তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
মহাভারতের যুদ্ধের চোদ্দতম দিনে অর্জুন জয়দ্রথ কে মারার জন্য অগ্রসর হয়। ভীমও তার ভাই অর্জুনকে সাহায্য করার জন্য দুর্যোধনের প্রেরিত শকটবাহুকে হত্যা করতে অগ্রসর হয়। এই সময়ে হঠাৎ করে বিকর্ণকে দুর্যোধন ভীমকে হত্যা করার জন্য প্রেরণ করে। তখন ভীম আর বিকর্ণ মুখোমুখি হয়ে ভীমের দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের সময় একমাত্র প্রতিবাদ করা বিকর্ণের কথা মনে পড়ে গিয়ে মন ইতস্তত হয়ে ওঠে। তারপর ভীম বিকর্ণ কে তার সামনে থেকে অথবা একদম যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ জানায়। কারণ ভীম বিকর্ণ কে হত্যা করতে চাইছিল না।
কিন্তু বিকর্ণ সেই কথায় রাজী না হয়ে উত্তর দেন যে, দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ বা যেকোনো নারীর সাথে কেউ খারাপ আচরণ বা অসম্মান করলে একজন কর্তব্য পরায়ণ ব্যক্তির যেটি করা প্রয়োজন সেটিই করেছেন মাত্র। তাই এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তার পরিজন তথা দুর্যোধনের হয়ে যুদ্ধ করাও তার ধর্ম। কোনো অবস্থাতেই নিজ আত্মীয়দের বিপদে ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়, এমনটাই কথা বলেন বিকর্ণ ভীমকে। তখন ভীম বিকর্ণের ধর্মজ্ঞান দেখে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে এবং ভীম বলে যে ভাই তুমি যখন তোমার ধর্ম ধারণ করে যুদ্ধ করতে এসেছ তাহলে আমাদের মধ্যে যুদ্ধই হোক। যুদ্ধ শুরু হলে কখনো বিকর্ণ ভীমকে পরাজিত করে তো কখনো ভীম বিকর্ণ কে।
এইভাবে যুদ্ধ চলার পর ভীম বিকর্ণ কে গদাযুদ্ধের আহ্বান করে। বিকর্ণ মূলত ছিলেন ধর্ণুধর; তাই তার গদাযুদ্ধ খুব একটা ভালো আসত না। তবুও প্রতিপক্ষ আহ্বান করায় বিকর্ণ গদা নিয়ে ভীমের কাছে যায়।
উভয়ের মধ্যে গদাযুদ্ধও ব্যাপক আকার ধারণ করে। কিন্তু অনেক প্রচেষ্টা করে যুদ্ধ করেও বিকর্ণ ভীমের কাছে পরাজিত হয় এবং মৃত্যু বরণ করে।
অনেক ইতিহাসকার ও পুরাণ বিশেষজ্ঞগণ তাই বিকর্ণ ও কুম্ভকর্ণকে একই মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি বলে মনে করেন। যদিও দুই যুদ্ধ আলাদা আলাদা সময়ে হয়েছিল, কিন্তু তারমধ্যেও অনেক কিছু বিষয়ের সমনতা ছিল ।
যেমনভাবে কুম্ভকর্ণ সত্য ও ন্যায়ের প্রতিমূর্তি হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভাইয়ের সাথ দেওয়ার জন্য রাম রাবণের যুদ্ধে সামিল হয়েছিল; ঠিক তেমনই বিকর্ণ অধর্মী ভাইয়ের দোষে যুদ্ধ হওয়ার কারণে নিজেদের কৌরব ভাইদের সাথ দেন।
কুম্ভকর্ণ একথা ভালো করে জানতেন যে রামের সাথে যুদ্ধ করে কোনোভাবেই পেরে উঠবে্ন না এবং রাবণের এখানে পরাজিত হওয়া নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত যখন কুম্ভকর্ণ বোঝাতে ব্যর্থ হয়; তখন ধর্মানুযায়ী নিজের ভাইয়ের হয়েই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে্ন পরাজিত হবে জেনেও।

যুদ্ধে বিকর্ণ ও কুম্ভকরণ উভয়কেই প্রাণ ত্যাগ করতে হয়।
মহাভারতের গাঁথায় যাকে ধর্মের স্বরূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে স্বয়ং ধর্মরাজ বলে অভিহিত যুধিষ্ঠির ও মহাদানী কর্ণও বিকর্ণের কাছে ফিকে অনুভূত হয়। যেখানে যুদ্ধে জেতার জন্য অশ্বত্থামার মৃত্যুর মিথ্যা খবর যুধিষ্ঠির কে বলতে হয়।
সেইসাথে সভামাঝে দুঃশাসনের দ্বারা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নীরব হয়ে থাকেন; সেখানে বিকর্ণ কূলবধূকে এমন অবমানবিক অত্যাচার থেকে প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। এদিকে সূর্যপুত্র কর্ণও সেই সময়ে ধর্মের পালন করতে অসমর্থ হয়।
কিন্তু বিকর্ণই এমন একজন ব্যক্তি যে জানত যে, ধর্মের সঙ্গ দিয়ে চলার পরেও নিজেদের ভাইদের অমানবিক কাজের জন্য মৃত্যুর মুখ দেখতে হবে। তবুও বিকর্ণ নাতো নিজের ভাইদের সঙ্গ ছেড়েছিল  নাতো নিজের ধারণ করা ধর্মের।
তাই যখনই আমরা পান্ডব, শ্রীকৃষ্ণ ও মহাভারতের কথা নিয়ে আলোচনা করব তখন যেন বিকর্ণের কথা না ভুলে যাই। 

যাজ্ঞসেনীর খুলছে শাড়ি , টানছে ধরে দুঃশাসন,
দায় ছিলো যার গর্জে ওঠার, নিচু মাথায় সে পাঁচজন।
দুর্যোধনের নগ্ন ঊরু. ইঙ্গিতে তার ধর্ষকাম,
হস্তিনাপুর দেখছে বসে, ধ্বস্ত হতে তার সুনাম।
অন্ধরাজা সিংহাসনে, আর্ত চেঁচান বৌমা তার,
নিজের দলের নির্যাতনে, সব রাজা হন নির্বিকার।
কর্ণ বসে হাসছে হা হা, রাজার দলের লোক তো সে
শর্তবিহীন সমর্থনেই , তাবত আরামসুখ বশে।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ নীরব, সরকারী লোক হাজার হোক
রাজার কথাই তোমার কথা, তুমি যখন রাজার লোক।
খল শকুনি দেখছে সবই, বস্তুত সে ধ্বংস চায়,
ঘরের মাটি লাল হয়ে যাক, দেশবিভাগের যন্ত্রণায়।
সুশীল সভায় ঘটছে যখন, রাজঅপরাধ জঘন্য,
ঠিক তখনই তার বিরোধে, চেঁচিয়ে ওঠেন বিকর্ণ।

বিকর্ণ নন কেউকেটা লোক, একশো ভাইয়ের একজনা
তেমন করে এর আগে কেউ, তার কথাটাই জানতো না।
জতুগৃহে কাড়েননি রা, অন্তত তা নেই লেখা,
ভীমকে যখন বিষ খাওয়ালো, তখনও তাঁর নেই দেখা।
কিন্তু যখন প্রকাশ্যতেই কাড়ছে নারীর আব্রু কেউ,
স্তব্ধ জিভের চুপসাগরে, বিকর্ণ হন একলা ঢেউ।
চেঁচিয়ে ওঠেন রাজার কুমার, যুবরাজের বিরুদ্ধেই,
মহাবলী পান্ডবেরও, তখন গলায় সে সুর নেই।
রাজাও যখন নীরব থেকে, সায় দিয়ে যায় ধর্ষণে,
ঠিক তখনই সমস্ত যুগ, বিকর্ণদের স্বর শোনে।

আমরা যারা কিচ্ছুটি নই ,একটি মোটে ভোট কেবল,
অত্যাচারের সামনে এলে, সঙ্গী শুধু চোখের জল
পোষ্যভাবে জাবনা চেবাই, অন্ধ এবং নি-কর্ণ,
প্রার্থনা থাক আমরা যেন, একবার হই বিকর্ণ।

মরার আগে হতেই হবে, রাজার সভায় বিকর্ণ।

লেখক: আর্যতীর্থ।


full-width

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!