ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১-৫২ সালে, যেখানে প্রথমবার ভোট প্রদান করা হয়। সে সময় ব্যালট পেপার ব্যবহৃত হত। ১৯৮২ সালে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় এবং ২০০৪ সাল থেকে এটি পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্বাধীন ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ভোট কারচুপি, রিগিং ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়; রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই একে অপরের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তুলে আসছে। তবে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথমবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই তথ্য-প্রমাণসহ ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ।
ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে ভোট চুরি (Vote Theft) একটি অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ, যা সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে কংগ্রেসের দাবি, ভোটার তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে এবং এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভোট চুরি করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপি বিরোধীদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছে। এই সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে, ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI) কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
কংগ্রেসের ভোট চুরি অভিযোগ ও প্রমাণ:
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে “ভোট চুরি” সংক্রান্ত তথ্য প্রমান সহ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। লোকসভার সাংসদ ও লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী, মহাদেবপুরা (কর্নাটক) এবং অন্যান্য নির্বাচনী এলাকা সম্পর্কে ভোটার তালিকার ভুল তথ্য দেখিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা এবং ভোট চুরির কথা তুলে ধরেছেন। কংগ্রেসের অভিযোগ, মহাদেবপুরার এলাকায় ১২০ জন ভোটারের একটিই ঠিকানা এবং একই বাড়িতে ৮০ জন ভোটার থাকেন এমনটাই ভোটার তালিকায় রয়েছে। ভোটার তালিকাগুলির মধ্যে অনেকেই ‘ফেক ঠিকানা’ ব্যবহার করে ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন। (thehindhi.com)।
কংগ্রেসের দাবি, কিছু ভোটার “ফর্ম ৬”–এর মাধ্যমে ভোটারের নিবন্ধন করেছেন, যা অবশ্যই নকল বা অবৈধ হতে পারে। কংগ্রেসের অভিযোগ, এভাবে ভোটার তালিকায় (একটি নির্বাচন ক্ষেত্রে প্রায় এক লক্ষেরও বেশী অবৈধ ভোটার) অবৈধ ভোটার যুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হচ্ছে। তারা আরো বলেছেন, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং ভোট চুরি বন্ধ করার জন্য একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালু করা উচিত।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে। তারা আরও অভিযোগ করেন যে, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগের যথাযথ তদন্তের ক্ষেত্রে কমিশন সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে “ভোট চুরি” অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচনী তালিকার ছবি এবং অন্যান্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এখন অবধি কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। (theprint.in)।
বিজেপির ভোট চুরি অভিযোগ ও প্রমাণ:
বিজেপি, কংগ্রেসের ভোট চুরি অভিযোগের পাল্টা অভিযোগ করেছে যে, বিরোধী দলগুলো একইভাবে ভোট চুরি করছে। বিজেপির নেতারা দাবি করেছেন যে, বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গাঁধী, অখিলেশ যাদব ও অন্যান্যরা ভুয়া ভোটারদের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। বিজেপির পক্ষ থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা অনুরাগ ঠাকুর বলেন, যে সমস্ত আসনে বিরোধীরা জয়ী হয়েছে, সেখানে ভোটারের তালিকা ও ভোট প্রদান প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। তিনি দাবি করেছেন যে, রায় বেরেলি, ওয়ায়ানাড, এবং ডায়মন্ড হারবার এর মতো আসনগুলোতে, যেগুলোর অধিকাংশ ভোটার বিরোধী দলের পক্ষের, সেখানে ভোট চুরির ঘটনা ঘটেছে (economictimes.indiatimes.com)।
বিজেপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অভিযোগ করেছে যে, বিরোধী দলগুলোর নেতারা নির্বাচন কমিশনকে ভুল তথ্য প্রদান করে ভোট চুরির অভিযোগ তুলে কমিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন। বিজেপির পক্ষ থেকে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন না করেই তোলা হয়েছে। কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কোন সঠিক প্রমান ছাড়াই অভিযোগ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপ:
যদিও কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের পক্ষ থেকে “ভোট চুরি” অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে কিন্তু ভারতীয় নির্বাচন কমিশন শুধু কংগ্রেস দলের “ভোট চুরি” এর অভিযোগে সাড়া দিয়েছেন। কংগ্রেসের ভোট চুরি অভিযোগের প্রেক্ষিতে, কমিশন দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, এসব অভিযোগ “ভিত্তিহীন” এবং “দায়িত্বজ্ঞানহীন”। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ধরনের অভিযোগ ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে (business-standard.com)।
কংগ্রেসের অভিযোগ অনুসারে, নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব ফেলতে এবং ভোট চুরির প্রতিবন্ধকতা কাটাতে নির্বাচন কমিশনকে আরও সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এই দাবিগুলিকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন এবং অভিযোগকারী হিসেবে রাহুল গান্ধীকে শপথপত্র (affidavit) জমা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। কমিশন আবার বলেছেন যে, তাদের কাছে “এক ব্যক্তি এক ভোট” নীতি অনুসরণ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই, এবং কোনো ধরনের চুরি বা অবৈধ প্রক্রিয়া গ্রহন করা হয়নি (theprint.in)।
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যে কোনো ধরনের অনিয়ম বা ভোট চুরি সম্পর্কে যদি নির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে, এবং অভিযোগকারী হিসেবে রাহুল গান্ধীকে শপথপত্র (affidavit) জমা করেন তবে তা তদন্ত করা হবে। কমিশন দাবী তারা বরাবরই স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করেছেন। কোন ধরনের অনিয়ম বা ভোট চুরি করা হয়নি।
অন্যদিকে, বিজেপির পক্ষ থেকে “ভোট চুরি” যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। যার ফলে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের দ্বিমুখী মনোভাব স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রমাণ এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা:
এখন পর্যন্ত কংগ্রেসর পক্ষ থেকে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সেগুলির সপক্ষে কার্যকর প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে যদিও নির্বাচন কমিশন কংগ্রেসর অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং দায়িত্বহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কংগ্রেস তাদের পক্ষে যে প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, কমিশন তা গঠনমূলক প্রমাণ হিসেবে গণ্য করেনি। বিজেপির পক্ষ থেকেও একপাক্ষিক অভিযোগ থাকলেও তাতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ প্রদান করা হয়নি।
ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি। কোনো দল বা ব্যক্তি যদি এভাবে ভোট চুরি বা ভোটের প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলে, তবে তা দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানে। নির্বাচন কমিশনের উচিত এই অভিযোগগুলির সঠিক তদন্ত করা এবং প্রমাণের ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যেন নির্বাচন পদ্ধতি আরও স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ হয়।
গণতন্ত্রের জন্য হুমকি: ভোট চুরি ও নাগরিক অধিকার:
গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হল মানুষের ভোটাধিকার। এই অধিকার যদি খর্ব হয় বা অবৈধভাবে পরিবর্তিত হয়, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের সংবিধান, বিশেষত ধারা ৩২৬, নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভোট চুরি বা ভোটারের অধিকার লঙ্ঘনের চেষ্টা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিপরীত এবং সংবিধানের লঙ্ঘন।
ভোটের প্রক্রিয়া যখন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হয়, তখনই জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা বজায় থাকে। কিন্তু যখন ভোট চুরি বা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, তখন তা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয় এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। আইনের প্রতিটি ধারা, যেমন জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ১৯৫১ এবং ইলেকটোরাল রোলস রুলস, ১৯৬০ (Electoral Rolls Rules, 1960), ভোট চুরির বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়। তবে, যদি নির্বাচন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়বে।
ভোটাধিকার একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তাই এর সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোট চুরি বা নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ প্রতিটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্টানের উচিত এসব অভিযোগের ওপর সঠিক তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেন জনগণের প্রতি সৎ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় এবং গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে।
◉ ORMD08945YD03850
এই প্রবন্ধটি যুক্তির বিভিন্ন মাত্রা বিশ্লেষণ করে তথ্য ভিত্তিক লেখা হয়েছে। এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পুর্ন ব্যক্তিগত, এটি পাঠক বা অন্যের মতামত প্রকাশ করে না।