লালন সাঁই দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন এবং উনিশ শতকের প্রায় পুরোটা সময় বেঁচেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘হিতকরী’ পত্রিকা সূত্রে জানা যায় লালনের মৃত্যু হয় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে। ‘হিতকরী’ তার মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পর প্রকাশিত এক সংবাদে এ কথা উল্লেখ করেন। সেখানে জন্মের সন তারিখ বলা হয় ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক। সেই হিসেবে গোটা উনিশ শতক জুড়েই লালন তাঁর সৃষ্টির সাধনায় মগ্ন ছিলেন। মানব হিতৈষণা ও হিতাকাঙ্ক্ষাই ছিল সেই সাধনার মূল সুর ও স্বর। লালন মানবতাবাদী ছিলেন। ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণ, শ্রেণী, বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি ভেদমুক্ত সমাজ গড়নের আহবান জানিয়েছিলেন গানে গানে। গোটা ঊনিশ শতকে তো বটেই বাংলা সাহিত্যে এবং বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসের কোথাও লালনের মতো চরিত্রের উপস্থিতি নেই।
 
লালন বাউল ছিলেন, সম্রাটও বটে। কিন্তু বাউল সাধনার ধারা ও ঐশ্বর্য বিকাশের পাশাপাশি তিনি মানুষের মুক্তি ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। চণ্ডীদাস সেই কবে লিখেছেন, 'শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'। লালন লিখেছেন, ' মিয়া ভাই কী কথা শুনাইলেন ভারী।/ হবে না-কি কেয়ামতে আযাব ভারী/ নর-নারী ভেস্ত মাঝার/ পাবে কি সমান অধিকার/ নরে পাবে হুরের বহর/ বদলা কি তার পাবে নারী? চণ্ডীদাস থেকে লালনের নিবেদনের ফারাক হল, তিনি কেবল নিবেদনই করেন না, প্রশ্নও জারি রাখেন। সেই প্রশ্ন কাকে বিদ্ধ করল আর কাকে রুঢ় এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল, তা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না লালন, এখানেই তার ব্যতিক্রমীতা ও স্বতন্ত্রতা নয় কেবলই, দ্রোহী সত্তার উন্মোচনেও তুলনারহিত এক উদাহরণ।
 
আমরা জানি, ঊনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ বা রেনেসাঁ সংঘটিত হয়। সেই নবজাগরণ হয়তো ইতালীয় নবজাগরণের আদলে হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ইতালীয় নবজাগরণ ছিল একটা স্বাধীন দেশের নবজাগরণ, বঙ্গ ছিল পরাধীন। আলাদা ভূগোল, আলাদা জনগোষ্ঠী , আলাদা সময়ে দাঁড়িয়ে যদি একই রকমের নবজাগরণ প্রত্যাশা করা হয়, তাহলে সেটা হবে অবান্তর ও অযৌক্তিক। বঙ্গীয় নবজাগরণ যতটা ছিল ইতালীয়, তার চেয়ে অধিক ছিল ইউরোপীয় আদল সদৃশ। এ কারণে ঊনিশ শতকে বঙ্গে নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল কি না এ প্রশ্ন করার চেয়ে এটা বলা যৌক্তিক যে বঙ্গীয় নবজাগরণ কতটা সার্থক হয়েছিল। এখানেই আমাদের জিজ্ঞাসা উনিশ শতকের নবজাগরণকে বঙ্গীয় নবজাগরণ বলা হলেও সেখানে কেন পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিস্থানীয় কেউ নেই। পূর্ববঙ্গের কেউ কি ছিল না কোন ক্ষেত্রেই? বঙ্গীয় নবজাগরণকে যদি কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণ বলা হয়, তাহলে কি সেটা অন্যায় বা একপেশে সিদ্ধান্ত হবে?
 
বঙ্গীয় নবজাগরণের সময়কালকে যদি উনিশ শতকের মধ্যে সীমায়িত করা হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে এই নবজাগরণ সংঘটিত হবার পর একটা শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, কিংবা প্রায় সোয়াশত শতাব্দী। এখনও বঙ্গীয় নবজাগরণের যে মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান এবং গবেষণা জারি রয়েছে সেখানে পূর্ববঙ্গের কারও উপস্থিতি নেই। অতি সম্প্রতি (মে ২০২২) প্রসাদ সেনগুপ্ত 'নবজাগরণের বঙ্গ ও বাঙ্গালি' নামে একটা বই লিখেছেন, যেখানে জায়গা পেয়েছে পূর্ববঙ্গের কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথ, প্রধানত সাংবাদিক-সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে খ্যাতিমান হলেও আরও নানাভাবে তিনি সেই সময়ের জনমানসের চাহিদা পূরণ করেছেন। শেষজীবনে 'ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল' করেও তিনি নদীয়া, পাবনা,নাটোর, রাজশাহী, ফরিদপুর, যশোর অঞ্চলের ভাবজগতে নবপ্রাণের জোয়ার আনেন। উল্লেখ্য, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন লালনের সমসাময়িক (১৮৩৩-১৮৯৬)। লালন কেবল অগ্রজ ছিলেন না, ছিলেন গুরু স্থানীয়, বন্ধু, স্বজন ও সদর্থক অর্থেই প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী। কাঙাল হরিনাথের দিনপঞ্জি ও কাঙাল শিষ্য জলধর সেন রচিত আত্মজীবনীমূলক রচনায় এ সম্পর্কে বিশদ উল্লিখিত হয়েছে।
 
উনিশ শতকের তৎকালীন নদীয়ার কুষ্টিয়া অঞ্চলে লালনকে ঘিরে একটা ভাবান্দোলনের জগত গড়ে ওঠে। যাদের সকলের লক্ষ ছিল মানব হিতৈষণা, মানবমুক্তি, সমাজের অন্যায় অবিচার বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মানুষকে রক্ষা করার। লালন ছিলেন এর কেন্দ্রে। একই সময়ে আমরা পাই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়'র মতো প্রমুখ বিদ্বজ্জনদের। উল্লেখ্য, এই নদীয়াতেই লালনের ইহাজাগতিকতার কয়েক শতাব্দী পূর্বে মহাপুরুষ চৈতন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি এক কলম না লিখেও বাঙলার সমাজ ও সাহিত্যে নতুন একটা যুগের প্রবর্তন করেছিলেন, একটা নবজাগরণের জন্ম দিয়েছিলেন। কেবল বঙ্গে নয়, গোটা ভারতেই নদীয়াকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে জ্ঞান করা হয়।
 
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে বঙ্গীয় রেনেসাঁয় যাদেরকে প্রাণ পুরুষ বলে জ্ঞান করা হয় এবং আজোবধি মান্যতা দেয়া হয়েছে সেখানে লালনের স্থান হয়নি। একে যদি আমরা প্রহেলিকা বা রহস্য বলে এড়িয়ে যায়, তাহলে সেটা কেবল দীনতা নয়, লজ্জারও, নাকি এখানেও জারি রয়েছে ভেদবুদ্ধির কোনো কৌশল।
 
উনিশ শতকে লালন যে প্রশ্ন জারি রেখেছিলেন একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সেইরকম প্রশ্ন হাজির করার কেউ নেই বললেই চলে। লালন বলেছিলেন, 'জাত গেল জাত গেল বলে/ একি আজব কারখানা,/ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/ সবি দেখি তা না-না-না।।/ আসবার কালে কি জাত ছিলে/ এসে তুমি কি জাত নিলে,/কি জাত হবা যাবার কালে/ সে কথা ভেবে বল না।।/ ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি/ এক জলেই সব হয় গো শুচি,/ দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তো কাকেও ছাড়বে না।/গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/ তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়,/ লালন বলে জাত কারে কয়/ এ ভ্রম তো গেল না।।'
 
লালন জ্ঞানসাধনার যে শ্রুতিনির্ভর ধারা তার উল্লেখ করার মতো সর্বশেষ প্রতিনিধি। লালন লেখাপড়া জানতেন না। একারণে গান লিখে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি লালন শিষ্যরাও তার সামান্য কয়েকটা গান লিখে রেখেছিলেন, যা আমরা রবীন্দ্রনাথের সূত্রে পেয়েছি। লালন গবেষণায় সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর সংগ্রহ-সংকলন-সম্পাদনা-ভূমিকায় 'রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালনের গানের পাণ্ডুলিপি' নামে বই লিখে সেই সুযোগ অবারিত করেছেন। দাদু, কবীর, লালনের যে পরম্পরা তার বৈশিষ্ট্য হল, শ্রুতিরূপে সেই জ্ঞান প্রবহমান থাকা। লিখিত জ্ঞানের বয়স সবেমাত্র দুইশ বছরের মতো। তার আগের যে হাজার হাজার বছরের জ্ঞান তা মূলত টিকে ছিল শ্রুতিরূপে। জ্ঞানের কয়েকটা স্তরায়নের মধ্যে শ্রুতিজ্ঞান এখন শক্তিশালী না হলেও টিকে রয়েছে। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতি জ্ঞানের একটা স্বরূপ মেলে লালন শিষ্য দুদ্দু শাহের একটা গানে, যেখানে উল্লেখিত হয়েছে, 'আমি লালনের সিঁড়ি/ ভাইবন্ধু নাই আমার জড়ি।।'
 
আহমদ ছফা 'লালন ফকির : হিন্দু কি যবন' শীর্ষক এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, জ্ঞান এবং কবিসত্তার সম্মিলন লালনকে এমন একটা উচ্চতর স্তরে নিয়ে গেছে, হিসেব করলে দেখা যাবে বাঙলার সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাধকদের মধ্যে লালনের একখানি আসন প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। এদিক দয়ে দেখলে পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে লালনের একটা তুলনা চলে। দুজনে একই সময়ের মানুষ। লালন এবং রামকৃষ্ণের যখন আগমন ঘটেছে সে সময়ে বাংলা দেশ নবযুগে প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে। বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম এবং তারপর রবীন্দ্রনাথ এসে গেছেন। নতুন যুগের মর্মবাণী একেবারে সাদামাটা গ্রাম্য বামুন রামকৃষ্ণকে স্পর্শ করেছে, একথা লালনের বেলায়ও খাটে।'
 
অথচ উনিশ শতকের নবজাগরণে রামকৃষ্ণকে প্রতিনিধিস্থানীয় জ্ঞান করার পাশাপাশি মান্যতা দেয়া হলেও লালনের ঠাঁই হয়নি। লালন পূর্ববঙ্গের, লালন ব্রাহ্মণ নয়, লালনের স্বামী বিকেকানন্দের মতো একজন ইংরেজি জানা শিষ্য ছিল না, লালন কলকাতার বাসিন্দা না হয়ে তৎকালীন নদীয়ার কুষ্টিয়ার মতো এক অজপাড়াগাঁয়ে ছিলেন- এসবই কি লালনকে উপেক্ষা বা আড়াল করার কারণ?
 
গোটা উনিশ শতকে আর কাউকে কী পাওয়া যাবে, যিনি একাই খুলে বসেছিলেন চিন্তার এরকম স্কুল। যে স্কুলে পাঠ করা হত অমেয় এই বাণী, 'চাতক বাঁচে কেমনে/ মেঘের বরিষণ বিনে।।/ তুমি হে নব জলধর/ চতকিনী ম'লো এবার।/ ঐ নামের ফল সুফল এবার/ রাখ ভুবনে।। তুমি দাতার শিরোমণি/ আমি চাতক অভাগিনী।/ তোমা ভিন্ন আর না জানি/ রাখ চরণে।।/ চাতক ম'লে যাবে জানা/ ঐ নামের গৌরব রবে না/ জল দিয়ে কর সান্ত্বনা/ অবোধ লালনে।।'
 
১৯৬৬ সালে মার্কিন সাময়িকী 'টাইম' প্রচ্ছদ করেছিল অভিনব একটা বিষয়ে। যেখানে ছিল না কোন ছবি, কেবল লেখা ছিল, 'Is God Dead?' এর কতো আগেই লালন লিখেছিলেন, 'চাতক ম'লে যাবে জানা/ ঐ নামের গৌরব রবে না/ জল দিয়ে কর সান্ত্বনা/ অবোধ লালনে।।' চাতক মলে আর ঈশ্বর থাকে না, থাকে না ঈশ্বর নামের গৌরব। ঈশ্বর জীবিত কি মৃত, ঈশ্বর কিসে থাকেন জীবিত আর কখন হয়ে যান মৃত তার ফায়সালা লালন শুধু এ গানে নয়, আরও একাধিক গানে সেই উনিশ শতকেই স্পষ্ট করেছেন। তারপরও বঙ্গীয় নবজাগরণের আয়নায় লালনের দেখা নেই।
 
বঙ্গীয় নবজাগরণকে যতভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার সবের সঙ্গে লালনের সৃজনসম্ভার যেভাবে মেলে অন্যদের ক্ষেত্রে তা কখনো কখনো খণ্ডিত বা অংশবিশেষ হলেও লালন কেন বঙ্গীয় নবজাগরণের প্রতিনিধি স্থানীয় চরিত্র নয়, তার উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। যেখানে লালন বলেছেন, 'এমন মানব জনম আর কি হবে?/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।/অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই।/দেব দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে।/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।/ কত ভাগ্যের ফলে না জানি,/ মনরে পেয়েছ এই মানব তরণী/ বেয়ে যাও ত্বরায় তরী/সুধা রয় যেন ভরনা ডুবি।/ এই মানুষ হবে মাধুর্য ভজন, তাইতে মানুষ রূপ গড়লো নিরঞ্জন।।/এবার ঠকলে আনা দেখি কিনা, অধীন লালন তাই ভাবে। / মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।'
 
লাললের জন্ম তিথিতে প্রতিবছর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন মেলার আয়োজন করা হয়। আর আয়োজন হয় দোল পূর্ণিমায়, যা লালন স্মরণোৎসব নামে সর্বজনে পরিচিত। বলা হয়, দোল পূর্ণিমার এই আয়োজন লালনের জীবদ্দশাতেই খুব ঘটা করা হতো। সেই থেকে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা ধারাবাহিকভাবে এই আয়োজন করে আসছে। এবছর বাঙালি মুসলমানের বিশেষ ধর্মীয় দিন শবেবরাতের কারণে দোল পূর্ণিমার এই আয়োজনকে একটু এগিয়ে নিয়ে ৪, ৫ ও ৬ মার্চ করা হয়। লালনতো কোন জাতপাতের ভেদ স্বীকার করেননি। এ কারণে নিজের পরিচয়কেও উহ্য রেখে গেছেন। তাহলে দোল পূর্ণিমার এই আয়োজন কেন বিশেষভাবে করেছেন তিনি।
 
উইকিপিডিয়া বলছে, ' দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোল পূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়।'
 
দোল পূর্ণিমার উৎসবকে দোলযাত্রাও বলা হয়। দোলযাত্রা সম্পর্কে জানা যায়, 'দোলযাত্রা একটি সনাতন হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। বহির্বঙ্গে পালিত হোলি উৎসবটির সঙ্গে দোলযাত্রা উৎসবটি সম্পর্কযুক্ত। এটির উদ্ভব ভারতীয় উপমহাদেশে এবং সেখানে বেশি উদযাপিত হয় তবে দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীদের মাধ্যমে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল এবং পশ্চিমা বিশ্বের কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই উৎসবের অপর নাম বসন্ত উৎসব।'
 
এখন আমরা অন্য একটা বিষয়ের দিকে নজর দেব। যেটা আমাদের সামনে হাজির করেছেন প্রসাদ সেনগুপ্ত 'নবজাগরণের বঙ্গ ও বাঙালি' বইয়ে। তিনি লিখেছেন, 'জমিদারের বিরুদ্ধে হরিনাথের সমস্ত অভিযোগ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রজাদের ন্যায্য অভিযোগ না-শোনা, প্রজাদের কাছে এমন দাবি করা যা বৈধ নয় এবং তা আদায়ের জন্য অত্যাচার করা এবং প্রজাদের ধর্মাচারের স্বাধীনতা কার্যত অস্বীকার করা। শেষোক্ত ব্যাপারটি ঘটল যখন দেবেন্দ্রনাথ নিজে মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী হয়ে গ্রামের গোপীনাথ মন্দিরের সংরক্ষণে সম্পূর্ণ অবহেলা দেখালেন, আর দোলযাত্রা ইত্যাদি নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠ-পোষকতা আর করতে চাইলেন না। কেবল তাই নয়, রক্ষণাবেক্ষণের লোক নেই বলে গোপীনাথের অলঙ্কার আর সাজসজ্জা খুলে নিয়ে যাওয়া হল নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। এটা হিন্দু প্রজাদের যথেষ্ট আঘাত দিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ আর দ্বারকনাথের মানসিকতার তফাতও এখানে ধরা পড়ে। দেবেন্দ্রনাথ ‍মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী হয়ে নিজের বাড়ি থেকে পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী-জনার্দন বিগ্রহ বার করে দিলেন। বাড়ির অন্যদের বিশ্বাস নিয়ে তাঁর মাথা ঘামাবার দরকার নেই। তিনি বাড়ির কর্তা। তাঁর বিশ্বাস নিয়েই সবাইকে চলতে হবে। দ্বারকনাথ বাড়ির বাইরে অনাচার করেন বলে পুরোহিতের পরামর্শে তাঁর পরিবার তাঁর ছোঁয়াচ বাঁচাতে চাইল। দ্বারকনাথ বললেন না- আমি বাড়ির কর্তা। আমার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে চাওতো অন্যত্র চলে যাও।– তিনি নিজে আলাদা বাড়ি করে সরে গেলেন। তিনি নিজের মতোই রইলেন; কিন্তু অন্যদেরও তাঁদের মতন থাকতে দিলেন, এবং কর্তা হিসেবে পরিবারের সব চাহিদা মেটাবার ব্যবস্থা করতে ভুললেন না। এবং ওই জমিদারি তিনি যখন কিনেছিলেন, তখন গোপীনাথ মন্দিরের পূর্ববৎ সংরক্ষণে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। সে প্রতিশ্রুতি তিন বরাবর রক্ষা করেছেন। উত্তরাধিকারীর আচরণকে হরিনাথ প্রতিশ্রুতিভঙ্গ বলেই মনে করেছেন।'
 
দোল পূর্ণিমা সম্পর্কে লালনের পক্ষপাত ও দুর্বলতা কি তাহলে এই তিনটি কারণে, এক. এই উৎসবের সঙ্গে ধর্ম নিরপেক্ষতার দিকটি যুক্ত রয়েছে। দুই. এই উৎসবের সঙ্গে মহাপ্রভূ চৈতন্যের জন্মতিথির যোগসূত্র রয়েছে। তিন. এই উৎসবের সঙ্গে স্থানীয় জমিদারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের বিষয়টি যুক্ত রয়েছে। যা স্পষ্ট হয়েছে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের মাধ্যমে। এই কাঙালকে ওই জমিদারের পাঠানো পাঞ্জাবি গুণ্ডা ও লাঠিয়ালদের হাত থেকে রক্ষার জন্য লালন শিষ্যসমেত ছেউড়িয়া থেকে ছুটে গিয়েছিলেন কুমারখালীর কাঙাল কুটিরে।
 
আমাদের অনুসন্ধান হল, লালনের এই দোলপূর্ণিমার প্রীতির মধ্যে দিয়ে মূলত মানুষের প্রতি তার পক্ষপাত, দুর্বলতা ও সর্বৈবপ্রকারে সহাবস্থানের দিকটিই হয়েছে উন্মীলিত ও উন্মোচিত। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো, মানুষকে কেন্দ্র করে আবির্ভূত হবে সবকিছু। উনিশ শতকের শতকের নবজাগরণও ছিল সেই লক্ষ্য থেকেই উৎসারিত। এ সময়ই লালন বলেছেন, 'এমন মানব জনম আর কি হবে?/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।/অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই।/দেব দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে।/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।'
 
লালন মানুষকে শুধু সবকিছুর ঊর্ধ্বে এবং কেন্দ্রেই প্রতিস্থাপন করেননি, দেব দেবতাগণেরও উপরে ঠাঁই দিয়েছেন। কোন রাখঢাক বা আড়াল না করে বলেছেন, 'দেব দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে।' মানুষকে এভাবে গর্ব ও গৌরবের জায়গায় দাঁড়াবার অধিকার লালন ছাড়া আর কেউকি দিয়েছেন। দেবতারাও চাচ্ছেন মানুষ জন্ম নিতে সেই কথা বলে লালন মানুষের মর্যাদাকে দেবতাদের উপরে ঠাঁই দিয়েছেন।
 
ব্রাহ্মধর্মের যে মানবমুক্তি ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন, রামমোহনের যে প্রগতি পন্থায় সমর্পিত সমাজ বদলের প্রচেষ্টা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যে শিক্ষানীতি ও সমাজ সংস্কারের লড়াই, রামকৃষ্ণ পরমহংসের যে ধর্ম সংস্কার ও স্বামী বিবেকানন্দের সংঘবদ্ধ আন্দোলন এসবের নির্যাসকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন লালন সাঁই। গানে গানে সেই আন্দোলন তিনি জারি রেখেছিলেন ঊনবিংশ শতক জুড়ে। তার গানে কেবলই যে ভাববাদ ছিল এমনটি নয়, ভাববাদকে তিনি যেমন মহীরুহসম এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তেমনই সমাজ সংস্কারে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সর্বোপরি মানুষের কল্যাণ সাধন ও মানুষের মুক্তিতে তিনি ছিলেন বঙ্গীয় নবজাগরণের কালের অন্যতম প্রধান এক চরিত্র ও চিন্তা চর্চার স্কুল বা তৎকালীন সময়ের রেওয়াজ অনুযায়ী চিন্তার টোল বা জ্ঞানের পাঠশালা। অথচ সেই জাগরণের সোয়াশত বছর পেরিয়েও লালন নেই বঙ্গীয় নবজাগরণের প্রতিনিধি স্থানীয়দের তালিকায়, আলোচনায়, ব্যাখ্যায়, বিশ্লেষণের ও মূল্যায়নের কোনো পর্যায়ে।

ORM008431CX06095

full-width